ভূমিকা
আল্লাহ সুবাহানাওতায়ালা বলেন,
“তোমাদের
উপর সাওম ফরয করা হল যেমন ফরয করা হয়েছিল পূর্ববর্তী উম্মাতগণের উপর যেন তোমরা
তাকওয়া অর্জন করতে পার।” [বাকারাঃ১৮৩]
সাওম একটি তাৎপর্যমণ্ডিত ইবাদত।এর
গুরুত্ব ইসলামে অত্যাধিক। ইসলামের পঞ্চ রুকনের এটি একটি অন্যতম ইবাদত।এই ইবাদতকে
যে অস্বীকার করবে সে কাফির হয়ে যাবে।এই ইবাদত সম্পর্কে নিম্নে আলোনা করা হলঃ
সাওম কি
রোযা ফারসী শব্দ, আরবী সিয়াম বা সাওম। এর আভিধানিক
অর্থ বিরত থাকা। সাওমের বহুবচন হল সিয়াম।(ছিয়াম) ক্রিয়ামূলটি (ছওম) শব্দমূল থেকে
উদ্ভূত। অর্থ- রোযা, পানাহার
ও নির্জনবাস থেকে বিরত থাকা। শব্দটির (ছোয়াদ) বর্ণ দ্বারা (ছিহাতে কুলূব) অর্থাৎ
অন্তরের বিশুদ্ধতা, (ইয়া)
বর্ণ দ্বারা (ইয়াদে ইলাহী) অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর স্মরণ এবং (মীম) বর্ণ দ্বারা (মা’রিফাতে
ইলাহী) অর্থাৎ আল্লাহ পাক-এর পরিচয় লাভের ইঙ্গিত বা প্রমাণ বহন করে।
পারিভাষিক সংজ্ঞা
আল্লামা আবুল হাসান বলেন, "নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে নির্ধারিত
বিষয়বস্ত্য থেকে বিরত থকার নাম হল সাওম"।
আল-কামুসুল ফিকহি এ বলা হয়েছে, "সাওম হল নির্দিষ্ট সময় সুনির্দিষ্ট
কার্যাবলী থেকে বিরত থাকা"।
আল্লামা যুরযানী বলনে, "সুবহি সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত
খাদ্য গ্রহণ এবং যৌনাচার থেকে নিয়তের সাথে বিরত থকার নাম হল সাওম"।
বদরুদ্দীন আইনী বলেন, "খাওয়া,পান করা এবং যৌন সঙ্গস্ররগ থেকে বিরত থাকার নাম হল
সাওম"।
শরীয়তের দৃষ্টিতে সিয়াম অর্থ সোবেহ
সাদেক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ ও শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-নিষেধ হতে নিয়তসহ
বিরত থাকাকে রোযা বলে। শরীয়াতে ঈমান, সালাত ও যাকাতের পরেই রোযার স্থান। ইহা ইসলামের
চতুর্থ রোকন। আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে ইহা একটি অপরিহার্য ইবাদত।
সাওম যাদের উপর ফরয
১. মুসলিম হওয়া
২. বালিগ হওয়া
৩. জ্ঞানবান হওয়া
৪. রোযা রাখার মত সুস্থ হওয়া
সাওমের গুরুত্ব ও ফযীলত
অপরিসীম।সাওমের ধর্মীয় এবং সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
ধর্মীয় গুরুত্ব
১.তাকওয়া অর্জনঃ সিয়াম সাধনার
দ্বারা একজন মুমিন বান্দা শ্রেষ্ঠ মানবীয় গুণাবলী তথা তাকওয়া সহজে অর্জন করতে
পারেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
“তোমাদের
উপর সাওম ফরয করা হল যেমন ফরয করা হয়েছিল পূর্ববর্তী উম্মাতগণের উপর যেন তোমরা
তাকওয়া অর্জন করতে পার।” [বাকারাঃ১৮৩]
কুরআন মাজীদে সাওমের তিনটি মৌলিক
উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে যা হলঃ
১. তাকওয়া অর্জন
২. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণাএ
৩. আল্লাহর শোকর গুজার হওয়া
২. প্রতিদান লাভঃ যারা রোযা রাখবে আল্লাহ তাদেরকে বিশেষভাবে
পুরষ্কৃত করবেন। তাই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,
“সাওম
কেবল আমার জন্য, আমি
নিজেই এর প্রতিদান দিব।”
৩. সওয়াব বৃদ্বিঃ যে ব্যক্তি রোযা
রাখবে সে বিশেষ পূণ্যের অধিকারী হবে। রাসূল (সাঃ)বলেছেন, এই মাসে যে একটি নফল আদায় করবে সে অন্য মাসে একটি ফরজ
আদায় করার সমান সাওয়াব পাবে আর যে এই রমযান মাসে একটি ফরজ আদায় করবে সে অন্য মাসে
৭০টি ফরজ আদায় করার সমান সাওয়াব পাবে। (বাইহাকী)
৪. ধৈর্য্য অর্জনঃ এই রোযা পালনের
মধ্য দিয়ে একজন বান্দা আল্লাহর নিকট চরম ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে সক্ষম হন। রাসূল
(সাঃ) বলেন,
“রমযান
মাস ধৈর্য্যের মাস আর ধৈর্য্যের বিনিময় হল জান্নাত”।
৫. কু-প্রবৃত্তি দমনঃ রোযাদার
ব্যক্তি নিজে সকল প্রকারের কু-রিপুকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়। তাই নবীজী(সাঃ)
বলেছেন,
“সাওম
ঈমানদারদের জন্য ঢালস্বরুপ”।
হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা রোযা রেখে মিথ্যা বলা,গীবত করার মত জঘন্য অপরাধকে পরিত্যাগ
করতে পারবে না আল্লাহ তাদের রোযা অবুল করবেন না। তাছাড়া হাদীসে আরও বলা হয়েছে যে, রমযান মাসে শয়তানকে আটকে রাখা হয়।
তাই এসময় যদি একজন মুমিন বান্দা সঠিকভাবে সাওম পালন করে তাহলে এর দ্বারা সে নিজেকে
অবশ্যই অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে।
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- যে ব্যক্তি
রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায়
আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
৬. সুপারিশ লাভঃ যারা নিয়মিত রোযা
রাখবে সেই রোযা তাদের জন্য হাশরের ময়দানে সুপারিশ করবেন। এ ব্যাপারে মুহাম্মদ(সাঃ)
বলেন,
“সাওম এবং
কুরআন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে।সাওম আল্লাহর কাছে বলবে হে আল্লাহ আমি তাকে দিনের
বেলায় পানাহার হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং, আমার সুপারিশ কবূল করুণ”।
৭. মাগফিরাত লাভঃ যারা নিয়মিত রোযা রাখবে তারা এর দ্বারা তাদের
পিছনের সকল গুনাহসমূহ মাফ করাতে পারবে। তাই রাসূল(সাঃ) বলেন,
সওয়াবের আশায় যে দিনে রোযা রাখবে
আর রাতে নামায পড়বে আল্লাহ তার পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন।
এছাড়া হাদীসে আরও বলা হয়েছে যে, ঈদের সকালে ফেরেশ্তারা সকল পথ-ঘাটে
এসে রোযাদার মুসল্লীদের ঈদ্গাহে জামাআতে শরীক হওয়ার জন্য আহবান জানাতে থাকে। যখন
তারা ঈদ্গাহে গমন করে তখন তাদের পূর্ণ পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়া হয় এবং এর দ্বারা
তাদের পিছরনের সকল গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং আল্লাহ তাদের প্রতি
পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট অর্জন করেন।
৮. নাজাত লাভ এবং জান্নাত
অর্জনঃ যারা রমযান মাসে সঠিকভাবে সিয়াম-সাধনা
পালন করবে আল্লাহ এর বিনিময় তাদের নাজাত দান করবেন এবং জান্নাত দান করবেন। এ
ব্যাপারে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রমযান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং
জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।তাই এই রমযান মাস হল জান্নাত লাভের একটি
সুবর্ণ সুযোগ। রাসূল (সাঃ) রোযাদারদের পরকালের পুরস্কারের ব্যাপারে বলেন,
“প্রতি
ইফতারের সময় দশ লক্ষ জাহান্নামীকে আল্লাহ মুক্তি দান করেন, লায়লাতুল কদর এবং জুমুয়ার দিন সেই পরিমাণ কয়েদীকে
মুক্তি দেওয়া হয় যেই পরিমাণ কয়েদীকে সব মিলিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়।”
৯.আখিরাতে বিশেষ মর্যাদাঃ যারা রমযান
মাসে সঠিকভাবে সিয়াম-সাধনা পালন করবে আল্লাহ এর বিনিময় তাদের জান্নাতে বিশেষ
মর্যাদা দান করবেন।রাসূল(সাঃ) বলেন,
“রোযাদার
ব্যক্তিদের রায়হান নামক একটি দরজা দিয়ে জান্নাত প্রবেশ করানো হবে।”
যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস
দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবেঃ হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই
দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে।
মুজাহিদদেরকে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদাদেরকে ডাকা হবে“রাইয়্যান” দরজা হতে । দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে । আবু বকর
(রাঃ) বললেন, হে
আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলি দরজা থেকে ডাকা হবে ..? যদিও এর কোন প্রযোজন নেই। জবাব
দিলেন হ্যাঁ । আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অর্ন্তভূক্ত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
১০. রমাদান মাসের মাহাত্ম :
রমযান মাস একটি তাৎপর্যমণ্ডিত
মাস।এ মাসে একজন বান্দা রোযার দ্বারা তার আত্মিক পরিশুদ্বতা অর্জনের পাশাপাশি
জান্নাত অর্জন করতে পারে।এ মাস হল কুরআন নাযিলের মাস তাই এই মাসের মর্যাদা
অন্যান্য ১১ মাসের তুলনায় অধিক হারে বেশি। আল্লাহ বলেন,
“রমাদান
মাস, ইহাতে
কুরআন নাযিল হয়েছে, যা
গোটা মানব জাতির জন্য জীবন যাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ
যা সঠিক ও সৎ-পথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিস্কাররূপে তুলে ধরে।
কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে সে যেন রোযা রাখে “(সূরা বাকারাঃ ১৮৫)।
রমাদান শব্দের বিশ্লেষণে দেখা যায়, “রমদ” শব্দের আভিধানিক অর্থ দগ্ধ করা, জালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করা। শরী‘য়তের ভাষায় এ মাসেই রোযার মাধ্যমে
রোযাদারের গুণাহগুলো জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং মু‘মিনের জীবন পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র
হয়ে যায়।
পবিত্র মাহে রমাদান গুণাহ মাফ
পাওয়ার একটি সুনিশ্চিত সময় ও সুযোগ দান করে। হযরত কা‘ব (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা মিম্বরে উঠার সময় তিনি
শিড়িতে তিনবার আমিন বললেন। সাহাবীগণ এর কারণ জানতে চাইলে উত্তরে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি যখন প্রথম শিড়িতে পা দিলাম তখন
জিবরাঈল (আঃ) বললেন,“ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে, রমাদানের রোযা পেল কিন্তু সে রোযা
রেখে জীবনে গুণাহসমূহ মাফ করাতে পারেনি। আমি বললাম, আমীন। অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) বললেন, ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে, আমার নাম শুনলো অথচ “ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম” পড়লো না।“আমি
বললাম, আমীন।
অতঃপর জিবরাঈল (আঃ) বললেন, “ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে, বৃদ্ধ অবস্থায় তার মা-বাবাকে জীবিত
পেলো, অথচঃ
মা-বাবার সেবা করে জান্নাতের ব্যবস্থা করে নিলো না”। আমি বললাম, আমীন (সহীহ আল-বুখারী)।
অতএব, রমাদান মাস গুণাহ মাফ করে চির মুক্তিলাভের একটি
নিশ্চিত সুযোগ লাভের সময়।তাছাড়া রাসূল (সাঃ) বলেন,
যখন রমযান মাস আসে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয়
। আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং শয়তানকে শৃংখলিত করে রাখা হয়।
(বুখারী ও মুসলিম)
১১.ক্ষতিপূরণ থেকে মুক্তিঃ যারা
রমযান মাসে রোযা রাখবে না তারা আখিরাতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।এই
ক্ষতিগ্রস্থের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রমযান মাসে রোযা রাখা উচিৎ।
রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে
ব্যক্তি কোন শরয়ী ওযর বা রোগ ছাড়া রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দিবে সে যদি সারা জীবন
ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না”।
সামাজিক গুরুত্ব
ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি সাওমের
সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। সাওমের সামাজিক গুরুত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
১. সহানুভূতিশীল হওয়াঃ এ মাসে
ধনী-গরীব একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে থাকে।এই সময় ধনী ব্যক্তি যেহেতু না
খেয়ে থাকে তাই সে গরীব মানুষের অভাব,ক্ষধার কষ্ট এবং পানির পিপাসা সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে
পারে। তাই সে গরীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। তাই মুহাম্মদ(সাঃ) বলেন,"রমযান মাস হল সহানুভূতিশীলের
মাস"।
২. বদভ্যাস দূরীকরণঃ রমযান মাসে
রোযা অবস্থায় মিথ্যাচার, ঝগড়া-বিবাদ, পরনিন্দা,হিংসা-বিদ্বেষ, অশ্লীল কথা-বার্তা দূর করার জন্য উদ্বুদ্ব করা
হয়েছে।তাই রমযান মাসে যে কেউ এ সকল বদ অভ্যাসসমূহ পরিহার করে নিজের চরিত্রকে
পূত-পবিত্র করতে পারে এবং আদর্শ সমাজ গঠনে এক সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৩. সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হওয়াঃ রমযান
মাসে ইফতারীর সময় এক অপর জনকে বাসায় দাও্য়াত দেয় এবং অপরের বাসায় ইফতার পাঠায় এবং
সাহরী ও ইফতারের সময় একই পরিবারের সকল সদস্যরা একত্রে আহার করে সকলের ভিতর একটি
সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে যা সামাইক বন্ধনকে দৃড় করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে।
৪. নিয়মানুবর্তিতা অর্জনঃ এই রমযান
মাসে একজন রোযাদার নির্দিষ্ট সময়ে রোযা রেখে সাহরী গ্রহণ করে,তারপর আবার সে কিছু কার্যকলাপ থেকে
বিরত থাকে।এরপর আবার সে একটি নির্দিষ্ট সময় ইফতার করে।আবার সে কিছু সময়ের জন্য
তারাবী পড়ে। দেখা যাচ্ছে এই রমযান মাসে রোযা রাখার মধ্য দিয়ে আল্লাহর একজন
প্রিয়বান্দা বিশেষ নিয়ামানুবর্তিতা শিক্ষা অর্জন করতে পারে।
৫. অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ এ মাসের
অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।এই সময় ধনী মুমলিমগণ সংযম পালন করার জন্য সর্বাধিক
চেষ্টা-প্রচেষ্টা করতে থাকে। অপব্যয় এবং কৃপনতা থেকে নিজেদের বিরত রাখার চেষ্টা
করে। অতিরিক্ত সওয়াবের আশায় ধনীগণ গরীবদের বেশী বেশী করে দান করে থাকে। ধনী-গরীবের
বৈষম্য হ্রাস্ব পায়।
৬. উচ্চ পর্যায়ে নৈতিকতাঃ এই মাসে
মানুষ নিজেকে পানাহার এবং যৌন সম্ভাগ থেকে বিরত রেখে নিজেদেরকে নৈতিকতার পর্যায়ে
অনেক উপরে নিয়ে যায় যার সামাজিক শিক্ষা অপরিসীম।
সাওমে বিসাল
বিসাল আরবী শব্দ যার অর্থ হল
নিরবিচ্ছিন্নভাবে দুটি বস্তুর পারস্পারিক ধারাবাহিকতা।
বযলুল মাজগুদ গ্রন্থাগার বলেন,
রাতের বেলা পানাহার না করে দুইদিন
বা ততোধিক দিন ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখাকে সাওমে বিসাল বলে।
মিরকাত গ্রন্থে বলা হয়েছে,
নৈশভোজ ব্যতীত একাধারে রোযা রাখাকে
সাওমে বিসাল বলে”।
ইমাম আবূ ইউসুফ এবং মুহাম্মদ(র.)
বলেন,
দুইদিন একটানা পানাহার ব্যতীত রোযা
রাখার নাম হল সাওমে বিসাল।
ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে রমযানকে
এমনভাবে বিশেষায়িত করতেন যা অন্য কোন মাসের বেলায় করতেন না। তিনি কখনো সেহরি গ্রহণ
করা থেকেও বিরত থাকতেন। উদ্দেশ্য ছিল রাত ও দিনের পুরো সময়টাই ইবাদতে কাটিয়ে দেয়া।
রাসূলুল্লাহ সাহাবাদেরকে সেহরি
গ্রহণ না করে সওমে বিসাল পালন হতে বারণ করতেন। তাদেরকে বলতেন:
“আমি
তোমাদের মত নই। আমি রাত্রিযাপন করি, অন্য এক বর্ণনায়, আমি আমার রবের সান্নিধ্যে থাকি। তিনি আমাকে খাওয়ান ও
পান করান”।
তিনি উম্মতের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে
সওমে বিসালকে নিষিদ্ধ করেছেন। তবে সেহরির সময় পর্যন্ত রোযা দীর্ঘায়িত করার অনুমতি
দিয়েছেন। সহীহ বুখারীতে আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
বলতে শুনেছেন,
“তোমরা
সওমে বিসাল পালন কর না। যে ব্যক্তি এরূপ করতে চায়,. সে যেন তা কেবল সেহরি পর্যন- করে”।
ইমাম আহমদ(র.) এর অভিমত
ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের মতে সাওমে
বিসাল জায়েয আছে। কারণ আয়শা(রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“রাসূল(সাঃ)
তোমাদের জন্য রহমতস্বরুপ সাওমে বিসাল নিষেধ করেছেন”।
ইমাম মালিক(র.) ও শাফিঈ(র.) এর
অভিমত
ইমাম মালিক(র.) এর মতে এধরনের সাওম
হারাম।কিন্তু ইমাম শাফিঈ (র.) ব্যখ্যা করেছেন যে, রাসূল(সাঃ) যেভাবে তা নিষেধ করেছেন তাতে তার সর্বোচ্চ
পর্যায় হারাম আর সর্বনিম্ন পর্যায় মাকরুহ।
ইমাম আবূ হানীফা(র.) এর অভিমত
ইমাম আবূ হানীফা(র.) এর মতে তা জায়েয নয়।কারণ তা
কেবলমাত্র নবীর সাথে সম্পর্কযুক্ত।তাই তা জায়েয হতে পারে না।আর হাদীসে বলা হয়েছে, “তোমরা
সওমে বিসাল পালন কর না। এই হাদীসে ধমকী অর্থে নিষেধ করা হয়েছে।
রমযানে সফর সংক্রান্ত আদর্শ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম রমযানে সফর করেছেন। সফর অবস্থায় তিনি কখনো রোযা রেখেছেন আবার কখনো
ইফতার করেছেন, অর্থাৎ
রোযা বিহীন অবস্থায় থেকেছেন। আর সাহাবাদেরকে এ দুয়ের যে কোন একটি গ্রহণ করার
স্বাধীনতা দিয়েছেন। শত্রুর কাছাকাছি পৌঁছে গেলে তিনি রোযা ভঙ্গ করার নির্দেশ
দিতেন। শত্রুদেরকে মোকাবেলা করার সময় শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশেই তিনি এরূপ করতেন।
নবী করিম (সাঃ)কে একবার সফর
অবস্থায় রোযার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন,
“যদি
রাখতে চাও তা পার আর রাখতে না চাইলেও তাও পার”।
ইবনে আব্বাস রা. থেকে রা. বর্ণিত,
রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোযা অবস্থায় সফর করে আসফান নামক স্থানে পৌঁছলেন। অতঃপর পান
পাত্র চাইলেন দিনের বেলায় মানুষকে দেখায়ে পান করলেন। রোযা না রাখা অবস্থায় মক্কায়
প্রবেশ করলেন।
ইবনে আব্বাস রা. বলতেন: সফর
অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোযা রেখেছেন এবং ভেঙ্গেছেন, দুটিই করেছেন। অতএব যার ইচ্ছে হবে
রোজা রাখবে, যার
ইচ্ছে হবে না রোজা রাখবে না। [বুখারী৪০২৯ মুসলিম ১১১২]
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন:
আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লামের সাথে সফর করছিলাম, রোযাদার এবং ভোজদার কেউ কাউকে কিছু বলেনি। [বুখারী ১৮৪৫
মুসলিম ১১১৮]
তবে যদি সফরে যুদ্ধ-লড়াইয়ের কোন অনুষঙ্গ না থাকত
তাহলে রোযা ভঙ্গের ক্ষেত্রে বলতেন, এটা হল রুখসত তথা সুযোগ, যে গ্রহণ করল, ভাল করল। আর যে করল না বরং রোযা রাখল তাতে তার কোন
পাপ হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বড় বড় অভিযানের প্রায় সবগুলোতেই, যেমন, বদর, উহুদ, খন্দক, তাবুক, ফাতহে মক্কা ইত্যাদি।
তবে তিনি কতটুকু পথ অতিক্রম করলে
শরীয়তসম্মত সফর হবে এবং রোযাদার ইফতার করতে পারবে, এ ব্যাপারে কিছু নির্ধারণ করেন নি। সফরের দূরত্ব
নির্ধারক কোন কিছুই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে প্রমাণিত
নয়।
সাহাবাগণ সফর শুরু করতেন। আর রোযা
ভঙ্গ করলে নিজ এলাকা অতিক্রম করে যাওয়ার পর ভঙ্গ করতে হবে, এ জাতীয় কোন শর্ত আরোপ করতেন না। সফরের শুরুতেই নিজ
বাড়ি-ঘর অতিক্রম করার পূর্বেই রোযা ভঙ্গ করতেন এবং বলতেন, এটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
আদর্শ।
উবাইদ বিন যাবর বলেন:
. আমি
সাহাবী আবু বসরা (রা) এর সাথে ফুসতাত থেকে সফরের উদ্দেশ্যে নৌকোয় আরোহণ করলাম।
তিনি নিজ এলাকার ঘর-বাড়ি অতিক্রম করার পূর্বেই দস্তরখান আনার জন্যে বললেন। এবং
আমাকে বললেন, কাছে আস।
আমি বললাম: আপনি কি এলাকার ঘর-বাড়িগুলো দেখতে পাচ্ছেন না? আবু বসরা বললেন: তুমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত উপেক্ষা করতে চাও।
মুহাম্মদ ইবনে কাব বলেছেন.
أ আমি
রমযানে আনাস ইবনে মালেকের কাছে গেলাম, তিনি সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সফরের উদ্দেশ্যে তার
বাহন প্রস্তুত করে রাখা ছিল। তিনি সফরের পোশাক পরিধান করলেন। অতঃপর খাবার আনতে
বললেন এবং গ্রহণ করলেন। আমি বললাম, এটা কি সুন্নত। তিনি বললেন, হ্যাঁ, সুন্নত। এরপর তিনি সওয়ার হয়ে রওয়ানা হলেন।
এই হাদীসগুলো রমযানে সফর অবস্থায়
রোযা ভঙ্গ করার অনুমতি প্রসঙ্গে খুবই
স্পষ্ট প্রমাণ।
রোযা রাখার ব্যাপারে চাঁদ দেখার
ব্যাপারে ইসলামী মনোভাব
চাঁদ দেখে রোযা রাখা বা না রাখা
ইসলামের একটি অন্যতম নির্দেশ।কুরআনে এসেছে,
“তোমার
নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময়
নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম”।[বাকারাঃ১৮৯]
রাসূল(সাঃ) বলেছেন,
“তোমরা
চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভংগ কর”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ ছিল, তিনি নিশ্চিতরূপে চাঁদ দেখা ব্যতীত, অথবা কোন এক ব্যক্তির সাক্ষ্য ব্যতীত মাহে রমযানের
রোযা রাখা শুরু করতেন না। একবার ইবনে ওমর রা. এর সাক্ষ্য অনুযায়ী রোযা রাখেন। জনৈক
বেদুইন ব্যক্তির সাক্ষীতেও রোযা রেখেছিলেন। এ দুই জনের দেয়া সংবাদের ওপর ভিত্তি
করেই রোযা রাখেন। রাসূলুল্লাহ তাদের দ্বারা সাক্ষ্য প্রদানমূলক বাক্য উচ্চারণ
করাননি। তাদের দেয়া সংবাদ যদি কেবলই সংবাদ হিসেবে ধরা হয়, তবে তিনি একজনের দেয়া সংবাদ তথা খবরে ওয়াহেদ কে
রমযানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে করেছেন। আর যদি বিষয়টিকে সাক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়, তবে তিনি সাক্ষ্যদাতাকে সাক্ষ্য
সংক্রান্ত শব্দ উচ্চারণ করতে বলেন নি। আর যদি চাঁদ দেখা না যেত অথবা এ ব্যাপারে
কারো সাক্ষ্য পাওয়া না যেত, তাহলে শাবান মাস ৩০ দিন পুরো করতেন। ২৯ শাবান দিবাগত রাতে আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে চাঁদ দেখা অসম্ভব হলে তিনি পুরো ৩০ দিন হিসেব করে শাবান
মাস শেষ করতেন, তারপর
রোযা রাখা শুরু করতেন।
মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে চাঁদ দেখা
না গেলে, সেদিন
তিনি রোযা রাখতেন না। এ ধরনের দিনে রোযা রাখার নির্দেশও তিনি কাউকে দেননি। আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় তিনি শাবান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করতেন। এটাই হল রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল ও নির্দেশ। এর সাথে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে তোমরা হিসেব
করে ধরে নাও বাক্যটির কোন বৈপরীত্য নেই।
হাদীসে ব্যবহৃত শব্দ (হিসেব করে
ধরে নাও) এর অর্থ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে শাবান মাস ৩০ দিন হিসেব করে গণনা করা।
বুখারির বিশুদ্ধ বর্ণনাতেও এর সমর্থন মেলে, বুখারিতে এসেছে,
(তোমরা
শাবান মাসের হিসেব পূর্ণ কর।)
মাহে রমযান সমাপ্তি বিষয়ে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ
এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ হচ্ছে,তিনি রমযান শুরুর ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ
করে মানুষকে সিয়ামের আদেশ করতেন, আর রমযান সমাপ্তির ব্যাপারে দুই ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ
করতেন।
ঈদের সালাতের সময় চলে যাওয়ার পর
যদি দুই ব্যক্তি চাঁদ দেখার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিত তবে তিনি রোযা ছেড়ে দিতেন এবং
অন্যদেরকেও ছেড়ে দিতে বলতেন, এবং পরদিন সময়মত ঈদের সালাত আদায় করতেন।
উপসংহার
সুতরাং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়
এবং সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সকলেরই সাওম পালন করা উচিত। আমরা নিষ্ঠার সাথে
সাওম পালন করব।
ধন্যবাদ
ReplyDeleteআপনাকেও ঘন্যবাদ
Delete