উসূলে
ফিকহে আমর হল খাসের অন্যতম একটি প্রকারভেদ। এর দ্বারা বান্দার উপর শরীয়াতের পক্ষ
থেকে কাজের আবশ্যকতা আরোপিত হয়।শরীয়াতের অধিকাংশ মাসালা এখান থেকে উদ্ভাবিত
হয়েছে।নিম্নে এই প্রকারের আমর সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হলঃ
আভিধানিক অর্থ
আমর
শব্দটি বাবে নাসারা এর মাসদার এটি একবচন যার বহুবচন হল উমুর ও আওয়ামির যার অর্থ হল
আদেশ দেওয়া ও নির্দেশ দেওয়া।কুরআনে এর অর্থ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।যেমনঃ
আদেশ
অর্থে,কাজ অর্থে,সিদ্বান্ত অর্থে,প্রলয় দিবস অর্থে, প্রত্যাদেশ অর্থে,বিষয় অর্থে,
অবস্থা অর্থে, জীবনব্যবস্থা অর্থে,অনুসন্ধান অর্থে ইত্যাদি।
পারিভাষিক সংজ্ঞা
আল
মানার প্রণেতা আল্লামা নাসাফী(রঃ) বলেন,
বক্তা
নিজেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে কাউকে কর বলে আদেশ করবে তাহলে তা আমর হবে।
এখানে
কর দ্বারা আদেশ করা হয়েছে আর যদি নিজে সে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন না হয় তাহলে তা
প্রার্থনা হবে।
আল্লামা
নিযামুদ্দীন শাশী(রঃ) বলেন,
অন্যের
উপর কোন কাজ অত্যাবশ্যকভাবে করে দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করাকে আমর বলা হয়।
সাইয়েদ
আহমদ হাশেমী বলেন,
বক্তা
নিজেকে সম্বোধিত ব্যক্তি থেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে তার থেকে কোন কাজ সমাধা
হওয়ার কামনা হল আমর।
দুরসুল
বালগাত প্রণেতা বলেন,
আদেশদাতা
নিজেকে সম্বোধিত ব্যক্তি থেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন মনে করে তার দ্বারা কোন কাজ
সম্পাদনের কামনা করাকে আমর বলা হয়।
আমিমুল
ইহসান বলেন,
আমর
হল আবশ্যক কোন শব্দ দ্বারা কাজ চাওয়া।
অর্থাৎ,
নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে কোন কিছু আদেশ দিয়ে কোন কাজ সম্পাদনের কামনার নাম হল
আমর।
আমরের
দ্বারা সঙ্ঘটিত কাজ মুসলিমগণের জন্য ওয়াজিব কিনা?
আমাদের
মহানবী(সাঃ) যেইসকল কথা তার নিজের মুখ দিয়ে বের বলেছেন তার উপর আমর ওয়াজিব
হবে।তদ্রুপ ফিলীর দ্বারা আমল করা ওয়াজিব হবে। আমাদের মুহাম্মদ(সাঃ) এর যেসকল কাজ
স্বাভাবজনিত কারণে ও বৈষয়িক ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনাগত ত্রুটির জন্য যেসকল কাজ
প্রকাশিত হয়েছে অথবা যা কেবল মহানবী(সাঃ) এর জন্য নির্দিষ্ট এই তিন ধরনের কাজ
উম্মতের জন্য ওয়াজিব নয় এই ব্যাপারে ইমামগণ একমত হলেও অন্যান্য কাজের ব্যাপারে
মতভেদ রয়েছে। এই সকল বিষয়াবলী দলীলসহ নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
১.
ইমাম আবূ হানীফা(রঃ) এর মতামত
ইমাম
আবূ হানীফা(রঃ) এর মতে নবী করিম(সাঃ) যা অনবরত করে গেছেন তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব
নয়।যদি তিনি কোন কিছু নিষেধ না করে থাকেন তাহলে তা ওয়াজিব হবে না। কেননা তার আমল
দ্বারা প্রমাণিত হয় এতে আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।
দলীল
ক।
রাসূলে করীম (সাঃ) যখন
সাওমে বিসাল পালন করতেন তখন তার দেখাদেখি সাহাবাগণ করতে চাইলে রাসূল তা করতে নিষেধ
করেছিলেন। তিনি তখন বলেন,
রাতদিন
পানাহার ছাড়া একাধারে রোযা রাখার শক্তি তোমাদের নেই। আমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ
ব্যাপারে আধ্যাত্মিক শক্তি দেওয়া হয়েছে।
খ।একদা জুতা পরিহিত অবস্থায় রাসূলে
করীম(সাঃ) নামাযের ইমামতি করছিলেন।এমতাবস্থায় জিবরাঈল(আঃ) রাসূলকে বললেন যে তার
জুতা নাপাক হয়ে গেছে।তখন রাসূল তার জুতা খুললে তার সাহাবাগণ তার দেখাদেখি জুতা
খুললে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) নামায শেষে তার সাহাবাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
কিসে
তোমাদেরকে জুতা খুলতে উদ্বুদ্ব করল? তারা বলল, আমরা আপনার জুতা খুলতে দেখে উদ্বুদ্ব
হয়েছি।
উপরোক্ত
হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর কাজ উম্মতের জন্য ওয়াজিব
নয়।
শাফিঈদের
মতামত
এই
মাযহাবের অনুসারীদের মতে, মুহাম্মদ(সাঃ) এর সকল কাজের দ্বারা আমর ওয়াজিব হবে। তারা
এইক্ষেত্রে দুটি দলীল পেশ করে থাকে যা হলঃ
১.
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
খন্দকের যুদ্বের দিন বলেছিলেন, তোমরা ঠিক সেভাবে নামায আদায় কর যেভাবে আমাকে
নামায আদায় করতে দেখ”।
২.আমর দ্বারা কথা বুঝানো হয় ।যেমনঃ “যখন তাদের মধ্যে কোন কাজ নিয়ে পরস্পর ঝগড়া
হয়”।
আমর
দ্বারা কাজ বুঝানো হয়। যেমনঃ “ফিরআউনের কোন কাজ সঠিক ছিল না”?
হানাফীদের
পক্ষ থেকে এর উত্তর
১.
হানাফীগণ বলে থাকেন যে,
এই ধরনের কথার দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় না যে, মুহাম্মদ(সাঃ) এর সকল কাজের দ্বারা
আমর ওয়াজিব হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এখানে যেই হাদীসটি বলা হয়েছে তা তার কথা অর্থাৎ,
তোমরা ঠিক সেভাবে নামায পড়বে এর দ্বারা তা খাস হয়েছে।
২.
উল্লেখ্য এখানে “ফিরআউনের কোন কাজ ছিল না”? এ আয়াতাংশে আমর দ্বারা ফিলী উদ্দেশ্য
করা মাজাজ হিসেবে হয়েছে।কেননা আমর হল সাবাব আর ফিলী হল মুসাব্বাব আর আমাদের আলোচ্য
বিষয় হল হল হাকীকাহ।তাই এই যুক্তিটি সঙ্গত নয়।
মালিকীদের
মতামত
আমরের
ব্যাপারে মালিকীগণ এই অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন যে, আমরের দ্বারা কেবল মাত্র একটি
কাজের বৈধতা প্রকাশ পায়।আল্লাহ বলেন,
তোমরা
আল্লাহর জন্যে শ্রম স্বীকার কর যেভাবে শ্রম স্বীকার করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে
পছন্দ করেছেন এবং ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা রাখেননি। [হাজ্জঃ৭৮]
মুতাযিলাদের
মতামত
মুতাযিলাগণ
এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে যে, আমরের দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে কাজটি করা যায়।
আমরের
পুনরাবৃত্তি
আমর
এর হুকুম দ্বারা তা পুনরাবৃত্তি হবে কিনা তা নিয়ে কতিপয় আলেমদের ভিতর মতপার্থক্য
রয়েছে।
হানাফীদের
মতামত
হানাফীদের
মতে আমরের হুকুম দ্বারা তা পুনরাবৃত্তি হয় না। তাদের দলীল নিম্নরুপঃ
দলীল
ক। আমর শব্দটি যেহেতু ফিয়েল মাসদার এর
সংক্ষিপ্ত রুপ। তাই মাসদারকে বারবার করার সম্ভাবনা রাখে। যেমনঃআরবীতে আমরের
সীগা ইদ্রীব শব্দের অর্থ হল আমি তোমার থেকে প্রহার কামনা করছি।এমনভাবে সাল্লু অর্থ
আমি তোমার থেকে নামায কামনা করছি। যতবার কামনা করা হবে তাই হবে।তা আমরের জন্য নয়
তা কামনার জন্য হবে।
খ।অনুরুপভাবে তোল্লাকী অর্থ তুমি তালাকের
কাজটি সম্পন্ন কর। সেতো ইদ্রীব সাল্লু তোয়াল্লাকী যথাক্রমে আদ-দারবু,আস-সোলাতু ও
আত তোয়লাকু মাসদারের সংক্ষিপ্ত রুপ।কিন্তু মাসদা আমর যে মাসদার থেকে
সংক্ষিওপ্পত করা হয়েছে, তা একটি সংখ্যার সম্ভাবনা রাখে না।আর আমর তার আকাল্লুল
জিনসের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আর তা হল একক। আর একক তো কোন সংখ্যার সম্ভাবনা রাখে না।
তাই বুঝা গেল যে, আমর তাকরার কামনা করে না ও সম্ভাবনা রাখে না।এখানে উল্লেখ করা
যেতে পারে ,যেইসব ইবাদত বারবার করা হয় যেমন নামায,রোযা,যাকাত ইত্যাদি এগুলো আমরের
কারণে করা হয় না। বরং, আসবাবের কারণে করা হয়।তা আসে বলে করতে হয়।
ইসহাকের
মতামত
আমর
পুনারবৃত্তি কামনা করে।
দলীল
তিনি
প্রমাণ হিসেবে বলেন, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, হে লোকসকল তোমাদের উপর আল্লাহ
তায়ালা হাজ্জ ফরয করেছেন”। তখন আকরা ইবন হাবিস(রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন,
হে
আল্লাহর রাসূল এটা কি এই বছরের জন্য নাকি সব সময়এর জন্য?
আকরা
(রাঃ) আরবী ভাষা-ভাষী হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর বাণী থেকে
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর বাণী থেকে পুনরাবৃত্তি বুঝিয়েছেন।সুতরাং, বুঝা গেল আমর
পুনরাবৃত্তি কামনা করে।
শাফিঈ
এর অভিমত
ইমাম
শাফিঈ(রঃ) ও তার কিছু সংখ্যক অনুসারীদের মতে আমর তার মামুরকে বার বার সম্পাদন
কামনা করে। এবং এর সম্ভাবনা রাখে।
দলীল
প্রামণ
পেশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আনসুরু শব্দের অর্থ আমি তোমার থেকে সাহায্য কামনা করছি।
আর সাহায্য শব্দটি হল অনির্দিষ্ট। নিয়ম আছে, অনির্দিষ্ট হা বোধকের অধীনে
নির্দিষ্টের উপকারীতা দিলেও আমের সম্ভাবনা রাখে। কাজেই বিশেষ কোন ইঙ্গিত পাওয়া না
গেলে আমর আম এবং পুনরাবৃত্তির অর্থে ব্যবহার করা হবে।
কতিপয়
আলেমের অভিমত
শাফিঈ
মতালম্বী কিছু সংখ্যক আলেমের মতে, আমরের সাথে কিছু শর্ত যুক্ত হলে সেই আমর
পুনারাবৃত্তি হবে।
দলীল
আল্লাহ
বলেন,
যদি
তোমরা অপবিত্র হও তাহলে পবিত্রতা অর্জন কর।
যে
চুরি করে সে পুরুষ হোক কি নারী হোক তার হস্ত কর্তন কর।
তোমরা
সালাত আদায় কর সূর্য ঢলে পড়ার সাথে সাথে।
প্রথম
আয়াতে অপবিত্রতা এই শর্তের জন্য পবিত্রতা বারবার অর্জন করতে হবে। ২য় আয়াতে, চুরির
দোষের জন্য হাত কাটতে হবে এবং শেষ আয়াতে সূর্য ঢলে পড়ার সাথে সালাতের পুনরাবৃত্তি
করতে হবে।
হানাফীগণের
পক্ষ থেকে উত্তর
আবূ
ইসহাকের হাদীসে হযুরত আকরা ইবন হাফিয বুঝে নেন যে, সময়ের পুনরাবৃত্তির সাথে সাথে
ইবাদতের পুনরাবৃত্তি হয়। এটা রোযা, কিংবা নামাযের সাথে সম্পর্কিত।কিন্তু হাজ্জ্বের
ব্যাপারে তিনি জানতেন যে, এটা সময়ের সাথে সম্পর্কিত আর সেটা বারবার আসে। কিন্তু
বায়তুল্লাহ শরীফ একটি শর্ত আর সেটা বার বার আসে না।এসব কারণে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন
আমরা তাকরার করে ভেবে নয়।
শাফিঈগণের
দলীলের উত্তর
শাফিফিঈগণ
যে যুক্তি দেখায় যে, আমর দ্বারা যা সাধারণ বিষয় আর সাধারণের সাথে সম্পর্কিত হল
আমরে মুকায়িদ যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় আমরে মাতলাক। অতএব
শাফিঈদের দলীল গ্রহণযোগ্য নয়।
উপসংহার
পরিশেষে
বলা যায় যে, আমর খাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।এর বিধান ওয়াজিব হলেও
মুহাম্মদ(সাঃ) এর সকল কাজ ওয়াজিব নয়।কারণ কিছু কিছু কাজ কেবলমাত্র মুহাম্মদ(সাঃ)
এর জন্য খাস ছিল আর আমরের হুকুম দ্বারা পুনরাবৃত্তির হুকুম বহন করে না।
No comments:
Post a Comment