Saturday 24 August 2013

প্রশ্নঃ ইমাম মালিক(রঃ) কে ছিলেন এবং তার সংকলিত মুয়াত্তা গ্রন্থের বৈশিষ্টাবলী নিয়ে আলোচনা কর এবং ২য় হিজরী শতকে এর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা কর।


ইলমে হাদীসের ইতিহাস ইমাম মালিক(রঃ) এর অবস্থান উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায়।তিনি হলেন সর্বপ্রথম মুহাদ্দিস যিনি একটি পূর্নাংগ এই হাদীসগ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। তার সংকলিত হাদীসগ্রন্থের নাম হল মুয়াত্তা যা হাদীস কিতাবসমূহের ভিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে রেখেছে।এই গ্রন্থের সংকলকের সংক্ষিপত জীবনী এবং এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে দেওয়া হলঃ 

ইমাম মালিকের জন্ম ও পরিচয়

মালিকী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আসবাহী(রঃ) ৯৩ হিজরী সনে মদীনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি ছিলেন একজন তাবি-তাবিঈ।তিনি হিময়ার রাজ বংশোদ্ভূত ছিলেন। তার প্রপিতামহ আবূ আমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর একজন সাহাবী ছিলেন।তার পিতামহ মালিক ইবন আমীর ছিলেন একজন প্রভাবশালী তাবিঈ এবং সিহাহ সিত্তার একজন অন্যতম রাবী। মালিক বিন আমিরের তিনজন পুত্র ছিল যারা হল আনাস,রবী ও আবূ সুহাইল নাফি। ইমাম মালিকের পিতা আনাস বংশানুক্রমে প্রাপ্ত ইলমের অধিকারী ছিলেন বটে কিন্তু ইলমে হাদীসের ব্যাপারে বিশেষ কোন জ্ঞান অর্জন করতে পারে নাই।তার মাতার নাম ছিল আলিয়া বিনতে শরীফ ইবন আব্দুর রহমান আল-আবদিয়াহ(রঃ)।

শিক্ষা জীবন এবং ওস্তাদবৃন্দ

তার চাচা আবূ সুহাইল নাফি ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস।তিনি বিখ্যার মুহাদ্দিস ইমাম যুহরীর ছাত্র ছিলেন।ইমাম মালিক(রঃ) শৈশবে তার প্রাথমিক শিক্ষা চাচা সুহাইলের কাছে থেকে গ্রহণ করেন।তিনি নাফি ইবন দাইলামী(রঃ) এর কাছে থেকে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।পারতপক্ষে বাল্যকাল থেকে ইমাম মালিক(রঃ) জ্ঞানচর্চার পরিবেশ গড়ে উঠে।কারণ তার পুরো জীবন অতিবাহিত হয় মদীনায় এবং মদীনায় সকল কুরআব-সুন্নাহের উপর বিজ্ঞ বিজ্ঞ সাহাব ও তাবিঈগণ বসবাস করতেন।তাই তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগের ফলে তিনি অত্যাধিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।ইমাম মালিকের সময় যেই সকল মুহাদ্দিসগণ সেখানে বসবাস করতেন তারা হলেন,ইবন মাসউদ, হিশাম ইবন উরওয়া, আব্দুল্লাহ ইবন দীনার, কাসিম বিন মুহাম্মদ বিন আবী বকর প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ।নাফি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি তার কাছে থেকে হাদীস শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।এরপর তিনি মদীনায় অবস্থিত সকল মুহাদ্দিসগণের কাছে থেকে হাদীস শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। তিনি হিযাযের ফকীহ রবীয়াতুর রায়(রঃ) এর কাছে থেকে ফিকাহশাস্ত্র অর্জন করেছিলেন।রবীয়াতুর রায় ছাড়াও সুফিয়ান সাওরী, মূসা বিন উকবা,ইয়াহয়িয়া বিন সাঈদের কাছে থেকে তিনি ফিকাহ শাস্ত্র অর্জন করেছিলেন।এভাবে করে তার উস্তাদের সংখ্যা অনেকে ছিলেন।শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী(রঃ) বলেন, ইমাম মালিকের উস্তাদ সংখ্যা ছিল ৭৫ আবার কেউ কেউ বলেন ৯৪।তবে জালালুদ্দীন সুয়ূতীর মতে তার উস্তাদের সংখ্যা ছিলেন ৯০০  যাদের ভিতর ৩০০ ছিলেম তাবিঈ এবং বাকি ৬০০ ছিলেন তাবী-তাবিঈ।

ইমাম মালিক(রঃ) এর শিক্ষাদান পদ্বতি ও বাকি জীবনী

ইমাম মালিক(রঃ) এর শিক্ষার আসর ছিল অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ।খুব সুন্দর পরিবেশে তিনি সকলকে শিক্ষা দীক্ষা দান করতেন। তিনি সুন্দর ও পরিপাটি জামাকাপড় পরিধান করে এবং আতর গায়ে দিয়ে সকলকে শিক্ষা দান করতেন। তিনি সারা জীবন মদীনায় অবস্থান করেছেন।তিনি কেবলমাত্র একবার মক্কায় হাজ্জের উদ্দেশ্যে গমন করেছিলেন। তার কাছে থেকে দূরান্তের অনেক লোকেরা এসে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতেন,বিশেষ করে আফ্রিকার লোকদের কাছে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন।
ইমাম মালিক একজন অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।এই ব্যাপারে ইমাম শাফিঈ(রঃ) বলেন,
ইমাম মালিক(রঃ) তাবিঈগণের পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য আল্লাহর জন্য এক অকাট্য দলীলস্বরুপ।
মুহাদ্দিস নাসাই বলেছেন,
আমার দৃষ্টিতে তাবিঈগনের পরে ইমাম মালিক(রঃ) থেকে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিলেন না।
তার ব্যাপারে বলা হয় যে, মালিক (রঃ) জীবিত থাকাকালীন সময় সেখানে তিনি ছাড়া আর কেউ ফাতওয়া দিতে পারতেন না।
তার এক পদমর্যাদা দরুন তিনি খলীফাদের নিকট থেকে প্রায় দশ হাজার দিরহাম পান।
আব্বাসীয় খলীফা মানসূরের নির্দেশে তিনি মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন।   তার এই মুয়াত্তা এতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, খলীফা মানসূর মদীনায় হাজ্জ করতে এসে বলেছিলেন,
আমি নিয়্যত করেছি যে, আপনার সংকলিত হাদীস গ্রন্থখানির অসংখ্য অনুলিপি তৈরী করে তা প্রত্যেক মুসলিম শহর ও নগরে পাঠাবো এবং সেই অনুযায়ী আমল করবে।এবং তাকে বাদ দিয়ে কোন হাদীসের মনোযোগ দিতে বলব না।
এই কথা শুনে ইমাম মালিকের খুশি হওয়ার কথা ছিল।বরং তিনি তা হন নাই।তিনি তখন খলীফাকে বলে দিলেন,
 না আপনি এই রুপ কখনও করবেন না।কারণ তাদের কাছে অনেক হাদীস পৌছে গিয়েছে। তারা অনেক হাদীস শুনেছে এবং তার উপর আমলও করছে।তাই যেভাবে আমল করছে তাই ছেড়ে দিন।
কথিত আছে যে, একবার খলীফা মানসূরের বিরুদ্বে বিদ্রোহ শুরু হলে মালিম(রাঃ) তার পক্ষে ফাতওয়া প্রদান করেছিলেন।তখন খলীফার চাচাত ভাই জাফর আব্বাসী তাকে বেত্রাঘাত করেন।কিন্ত খলীফা এই ঘটনা শুনে মর্মাহত হন এবং তার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
অতঃপর খলীফা হারুনুর রশিদও মুয়াত্তার প্রচার এর কাজ করতে চান এবং তা পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফে ঝুলিয়ে তা থেকে সকলকে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছিলেন।কিন্তু ইমাম মালিক(রঃ) তাকে তা বারণ করে বলেনঃ
না আপনি তা করবেন না।কেননা রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে খুটিনাটি ব্যাপারে মত পার্থক্য রয়েছ,তারা বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।আর তারা সকলে সঠিক পথে রয়েছে।
তার এই বক্তব্যের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনী বিষয়ে খুটি-নাটি মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক।এরজন্য গোড়ামির মাধ্যমে নিজের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইমাম ইবনে আব্দুর বার বলেছেন,
সমাঝদার লোকদের ভিতর এটা একটি ইনসাফপূর্ণ নীতি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
খলীফা হারুনুর রশিদ একবার মদীনায় রাসূলুল্লাহ(সাঃ) রওযা যিয়ারত করতে আসলে তিনি ইমামকে তাদের নিকট এসে তার দুই পুত্র আমীন ও মামুনকে দ্বীনী শিক্ষা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান।কিন্তু তার উত্তর ইমাম সাহেব বললেন, ইলম হল সম্মানের বিষয়বস্তু আর আপনি একে অপমানিত করতে পারেন না। তখন তার দুই পুত্র ইমামের দরবারে এসে শিক্ষা লাভ করেন।
ইমাম মালিকের বাকি জীবন মদীনা বসেই শিক্ষা ও ফাতওয়া দানের মাধ্যমে কেটে যায়।তার চারিত্রিক গুণাবলীর ভিতর দানশীলতা,মহানুভবতা,হাসোজ্জ্বলতা,মহত্তা,জ্ঞানের গভীরতা ও বিনম্রতা ছিল উল্লেখযোগ্য।রাসূলের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্বা ছিল বর্ণনাতীত।এমন কি মুহাম্মদ(সাঃ) এর দেগ মোবারক এখানকার মাটিতে শায়িত আছে বলে তিনি কখনো সাওয়ারীর উপর চড়তেন না।
 ১৭৯ হিজরীতে ৮৩ বছর বয়সে তিনি মদীনায় ইন্তিকাল করেন।তাকে পবিত্র জান্নাতুল বাকী সমাহিত করা হয়।

মুয়াত্তা পরিচিতি

মুয়াত্তা আরবী শব্দ যা মুতউন শব্দ হতে এসেছে।যার অর্থ হল উপর চলা,পথ চলা।পারিভাষিকভাবে যেই পথে মুত্তাকীগণ চলেছেন তাই হল মুতউন।হাদীস বিশারদ্গণের মতে, পূর্ববর্তী মুত্তাকীগণ যেই পথে চলেছেন তার উপর ভিত্তি করে এর নামকরণ করার হয়েছে।
এই গ্রন্থের নামকরণের ব্যাপারে স্বয়ং ইমাম মালিক(রঃ) বলেন,
আমি এই কিতাবখানী মদীনার প্রায় ৭০ জন ফকীহবিদের  নিকট পেশ করেছি।তারা সকলে আমাকে এই কিতাবের ব্যাপারে উপদেশ দিত।তাই আমি এর নাম দিয়েছি মুয়াত্তা।
সেই অর্থ থেকে মুয়াত্তার অর্থ হয় সমর্থিত,সুজ্জিত ও পুনর্বিন্যস্ত।
খলীফার আদেশে উদ্যোগ
ইমাম মালিক(রঃ) এই হাদীসগ্রন্থ রচনা করেছিলেন আব্বাসীয় খলীফা মানসূরের নির্দেশক্রমে।মুহাম্মদ আবূ যাহু বলেন,
আব্বাসী খলীফা মানসূর ইমাম মালিককে ডেকে বললেন, তিনি যেন তার নিজের কাছে প্রমাণিত এবং সহীহরুপে সাব্যস্ত হাদীসসমূহ সংকলন করে এবং তা যেন একখানি গ্রন্থরুপে তা প্রণয়ন করেন এবং তা যেন লোকদে ব্যবহারিক জীবনের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন।অতঃপর তিনি তার এই গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং তার নাম নির্দিষ্ট করেন আল-মুয়াত্তা

ইমাম মালিকের মুয়াত্তা সংকলনের পদ্বতি

ইমাম মালিক (রঃ) এই গ্রন্থটি প্রণয়নের জন্য অধিক হারে পরিশ্রম করেছিলেন। ইমাম সুয়ূতী ইবনুল হুবাব এর সূত্রে উল্লেখ করেছেনঃ
ইমাম মালিক(রঃ) এখনে সর্বপ্রথম এক লাখ হাদীস বর্ণনা করেন। তা থেকে দশ হাজার হাদিস নিয়ে মুয়াত্তা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।অতঃপর তিনি সেই গ্রন্থকে কুরআন-সুন্নাহের আলোকে যাচাই করেন।সাহাবীদের আসার ও অন্যান্য খবর এর ভিত্তিতেও তার পরীক্ষা করেন।শেষ পর্যন্ত তাতে মাত্র পাচশ হাদীস সন্নিবেশিত হয়।
ইমাম সুয়ূতী আতীক বিন ইয়াকুবের সূত্রে নিম্নোক্ত বর্ণনা পাওয়া যায়ঃ
ইমাম মালিক প্রায় দশ হাজার হাদীস নিয়ে মুয়াত্তা প্রণয়ন করেন।অতঃপর তার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন এবং যাচাই বাছাই করে হাদীস প্রত্যাহার করতেন এবং শেষে তা বর্তমান রুপে ধারন করে।
গ্রন্থ রচনার সময়কাল
এই গ্রন্থ রচনা করতে কত সময় লাগে সেই ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ বলেন,
ইমাম মালিকের এই গ্রন্থ প্রণয়নে প্রায় ৪০ বছর লেগে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে তিনি তার যাচাই-বাছাই করতে থাকেন এবগ্ন কাট-ছাট করতে থাকেন এবং তা সুসংবদ্বরুপে , সজ্জিত,নির্ভুল ও শৃংখলিত করতে ব্যস্ত ছিলেন।
উপরের ইবনুল হুবাবের সূত্রে উল্লেখিত ইমাম সুয়ূতী্র। উদ্বৃতি হতে জানা যায় যে, ইমাম মালিক (রঃ) প্রায় দশ হাজার হাদীসের মধ্য থেকে ৫০০ হাদীস তার গ্রন্থে সংকলন করেছিলেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুয়াত্তা গ্রন্থে কতটি হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে তার সঠিক হিসাব জানা যায় নাই।ইমাম সুয়ূতীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মুয়াত্তা গ্রন্থে রাসূলে করীম(সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীদের থেকে বর্ণিত হাদীস সংখ্যা হল ১৭২০টি
তন্মধ্যে সনদযুক্ত ৩০০টি যার ভিতর মুরসাল হাদীস হল ২২২টি,মওকূফ হল ৬১৬টি এবং তাবিয়ীদের হল ২৮৫টি।ইমাম হাযম(রঃ) বলেন,
আমি মুয়াত্তা গ্রন্থের হাদীস গণনা করেছি।গণনা করে যা পেলাম মুসনাদ হাদীস ৫০০ এর চেয়ে কিছু বেশী এবং মুরসাল ৩০০ এর মত।এছাড়া ৭০টি হাদীস এমন আছে যে, যার অনুসরণ  ইমাম মালিক(রঃ) নিজেও বর্জন করেছিলেন।

এ গ্রন্থের নুসখা

মুয়াত্তা গ্রন্থের নুসখা অসংখ্য।তন্মধ্যে তিনশ নুসখা অত্যন্ত প্রসিদ্ব।তন্মধ্যে তিনটি নুসখা অত্যন্ত প্রসিদ্ব।এইসকল হাদীসগ্রন্থসমূহের ভিতর হাদীসের সংখ্যা কম-বেশী বিদ্যমান আছে।ইমাম সুয়ূতী তিনটি নুসখার কথা উল্লেখ করেছেন যা যা হলঃ
১। ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়ারী লাইসী আন্দুলসীকৃত নুসখাঃ তিনি সরাসরিভাবে ইমাম মালিকের কাছে থেকে তিনটি অধ্যায় ছাড়া প্রায় সকল হাদীস শ্রবণ করেছিলেন।
২। আবূ বকর মুসায়িব আহমেদ বিন আবী বকর আল কাসিম কৃতঃ তিনি মদীনার বিচারপতি ছিলেন এবং তার এই নুসখা ইমাম মালিক(রঃ)কে সর্বশেষ শোনানো হয়েছিল। এতে অন্যান্য নুসখার তুলনায় প্রায় ১০০টির অধিক হাদীস লিপিবদ্ব হয়
৩।ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শায়বানী কৃত নুসখাঃ তিনি আবূ হানিফা(রঃ) এবং ইমাম মালিক দুইজনের কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন।

মুয়াত্তা গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যাবলী

মদীনাবাসীর বর্ণনার উপর ভিত্তি করে রচিত

মুয়াত্তা হল ইমাম মালিক(রঃ) কর্তৃক সংকলিত সর্বপ্রথম হাদীস গ্রন্থ।এই হাদীসগ্রন্থটি পুরোপুরিভাবে মদীনাবাসীদের বর্ণনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হাদীসগ্রন্থটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য ইমাম মালিক(রঃ)কে মদীনার বাইরে গমন করতে হয় নি। মদীনার লোকেরা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এবং তার সাহাবাদের সবচেয়ে সান্নিধ্য অবস্থান করতেন। তাই তাদের কাছে থেকে অতি সহজে তা গ্রহণ করা যায়।

ক্রমানাসুরে হাদীস বিন্যাস

এই গ্রন্থের আরেকটি বিশেষত্ব হল এই যে, প্রথমে এখানে মহানবী(সাঃ) এর হাদীস- কথা ও কাজ এবং এরপর সাহাবাদের কথা এবং এরপর তাবিঈদের কুরআন-হাদীসভিত্তিক ফাতওয়া এভাবে ক্রমানুসারে সাজানো হয়েছে। 

সনদের বিশুদ্বুতা

মুয়াত্তা গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা উত্তম সনদ হল জোড়া সনদ।যা মাত্র দুটি সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়।যেমন মালিক নাফি,নাফি বিন উমর (রাঃ) এর সনদ হল হাদীস জগতে স্বর্ণ সনদ।সনদের বিচারের দিক দিয়ে মুয়াত্তার স্থান সবার আগে।কারণ এখানে তার থেকে মুহাম্মদ(সাঃ) পর্যন্ত তিনের অধিক কখনও অতিক্রম করে নাই।কারণ একটি হাদীসে যত বেশী বর্ণনাকারী থাকবে তার সনদের বিশুদ্বতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকবে।কিন্তু এই গ্রন্থের একটী বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এখানে সাহাবা,তাবিঈ এবং তাবী-তাবিঈ পর্যন্ত একটি হাদীস বর্ণিত হওয়ার পর তা গ্রন্থে লিপিবদ্ব হয়।তাই সনদের বিশুদ্বতা এই গ্রন্থে অন্যান্য গ্রন্থেগুলোর তুলনায় অত্যাধিক।

ইমামের নিজ হাতে সংকলিত

এই গ্রন্থের জনপ্রিয়তা তৎকালীন ইমাম আবূ হানীফার কিতাবুল আসার, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ এর মুসনাদ থেকে অধিক জনপ্রিয় ছিল।কারণ এই গ্রন্থটি ইমাম মালিক(রঃ) ব্যতীত আর কেউ সহস্তে তা লিখে নাই।তিনি এই গ্রন্থটিকে কাট-ছাট করে,যাচাই-বাচাই করে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তা প্রকাশ করেছিলেন।

বর্ণনারীদের আধিক্য

এই গ্রন্থের কথা প্রায় ১০০০ ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন।এতে প্রমাণিত হয় যে, সেই সময় ইসলামী সমাজে মুয়াত্তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল। জনগণ তা সাদরে গ্রহণ করেছিল।বর্ণনাকারীদের আধ্যিকের কারণে এই গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা বেশী।

ব্যাখ্যাগ্রন্থের আধিক্য

মুয়াত্তা গ্রন্থের ব্যাখ্যা গ্রন্থ অসংখ্য। এর সংখ্যা প্রায় ৩০০ এর অধিক হবে। ইমাম হাবীব মালিকি সর্বপ্রথম এই গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন,অতঃপর আব্দুর বার, যারকানী এবং  আবূ বকর ইবনুল আরাবী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ সংকলন করেন। 

রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর ভবিষৎবাণী

 বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য পণ্ডিতবর্গ মদীনাতে এসে মুয়াত্তার শিক্ষা গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) তার এই হাদীসগ্রন্থের ব্যাপারে পূর্বে ভবিষৎ বাণী করেছিলেন।রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
সেই সময় খুব দূরে নয় যখন জনগণ ইসলাম হাসিলের জন্য উষ্ট্রপিঠ হতে দূর দূর দেশ সফর করবে এবং তারা মদীনায় অবস্থানকারী আলিমের চেয়ে আর বড় আলিম কাউকে পাবে না।
ইবনে উয়াইয়া এবং আব্দুর রাযযাক এই কথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করে নিয়েছে যে,এখানে যেই আলেমের কথা বলা হয়েছে তিনি হলেন, ইমাম মালিক(রঃ)।
মুয়াত্তার ব্যাপারে বিশেজ্ঞ আলেমদের মতামত
ইমাম শাফিঈ(রঃ) এই মুয়াত্তা গ্রন্থের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করে বলেছেন,
আল-কুরআনের পর মুয়াত্তা থেকে অধিক বিশুদ্ব গ্রন্থ আর কিছুই হতে পারে না।
পরবর্তীতে প্রসিদ্ব মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া বলেছিলেনঃ
এতখানি আস্থা ও নির্ভরতা অপর কোন কিতাবের উপর স্থাপিত হয় নাই।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী(রঃ) এবং তার পুত্র শাহ আব্দুল আযীয বলেন, মুয়াত্তা হল সহীহায়নের মাতা।
এই হাদীস গ্রন্থে বুখারী ও মুসলিমের চেয়ে প্রায় দশ গুণ হাদীস বেশী থাকলেও হাদীসগ্রন্থ বিন্যাস করার পদ্বতি,সনদ বিচার করার নিয়ম ও হাদীস হতে ফিকহ বের করার নিয়ম তার এই মুয়াত্তা থেকে বের হয়েছে।
হাফিয ইবন আসকালানী(রঃ) বলেন, ইমাম মালিকের মুয়াত্তা গ্রন্থটি তার এবং তার অনুসারীদের মতে সহীহ।কেননা তার দৃষ্টিতে মুরসাল,মুনকাতি ইত্যাদি হাদীস উল্লেখযোগ্য।
হুজ্জাতুল বালিগা গ্রন্থাগার বলেন, অন্যান্য মুহাদ্দিসের মতে মুয়াত্তা গ্রন্থে যেইসকল মুরসাল ও মুনকাতি হাদীস রয়েছে, তা অন্য সনদে মুত্তাসিল স্তরে উন্নীত হয়েছে,কাজেই এইদিক দিয়ে হাদীসসমূহ সহীহ। 
উপরোক্ত  বৈশিষ্ট্যবালীর আলোচনা থেকে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, মুয়াত্তা গ্রন্থটি  হিজরী ২য় শতকে একটি শ্রেষ্ঠ হাদীস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামী ইলমের ইতিহাসে মুয়াত্তা একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।যদিও এর স্থান সিহাহ সিত্তার বাহিরে কিন্তু তারপরও এই হাদীসটি সেই সমমানের একটি কিতাব এবং সনদের বিশুদ্বতার দিক থেকে একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।


No comments:

Post a Comment

৩৮ তম বিসিএস এর রেজাল্ট

৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এ কথা নিশ্চিত করেন। ...