Friday 23 August 2013

কোর্স নং-৪০৭ প্রশ্ন-তাকলীদ কাকে বলে এবং কুরআন-হাদীসের আলোকে তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।

ভূমিকা

আল্লাহ বলেন,
 আল্লাহর আনুগত্য কর, তাঁর রসুলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ প্রদানকারী রয়েছে, তাদেরও। [নিসাঃ৫৯]
উক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক মানুষকে একটি নির্দিষ্ট মাযহাব মানতে বা তাকলীদ করার গুরুত্বের কথা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বলেছেন। তাকলীদ সম্পর্কে একটি সম্যক ধারনা নিম্নে পেশ করা হলঃ

তাকলীদ কি?

তাকলীদ (التقليد) শব্দটি ক্বালাদাতুন (قلادة) হতে গৃহীত। যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। যেমন বলা হয়, قَلَّدَ الْبَعِيْرَ সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে। সেখান থেকে মুক্বাল্লিদ (مقلد) , যিনি কারো আনুগত্যের রশি নিজের গলায় বেঁধে নিয়েছেন। 
যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, আয়শা(রাঃ) বলেন,
আমি আসমার কাছে থেকে হাড় ধার(কিদালা) করেছি।
একইভাবে কোন ধরনের দলীল ছাড়া কারও কথা ও কর্মের অনুসরণ হল তাকলীদ।

পারিভাষিক সংজ্ঞা

তাক্বলীদ হল শারঈ বিষয়ে কোন মুজতাহিদ বা শরীআত গবেষকের কথাকে বিনা দলীল-প্রমাণে চোখ বুজে গ্রহণ করা। আল্লামা জুরজানী (রহঃ)-এর মতে,
তাক্বলীদ হল বিনা দলীল-প্রমাণে অন্যের কথা গ্রহণ করা
ইমাম শাওকানী (রহঃ)-এর মতে,
 তাকলীদ হল বিনা দলীলে অন্যের মত গ্রহণ করা, যার মত দলীল হিসাবে সাব্যস্ত হবে না

ইমাম গাযালী(রঃ)  বলেছেন,
কারও কথাকে প্রমাণ ছাড়াই মেনে নেওয়া।

তাফসীরে আযওয়াউল বায়ান-এর লেখক মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী (রহঃ)-এর মতে,
 তাক্বলীদ হল কারো দলীল সম্পর্কে অবহিত না হয়ে তার কথা গ্রহণ করা
তাক্বলীদের উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, শারঈ বিষয়ে কারো কোন কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করাই তাক্বলীদ। পক্ষান্তরে দলীলসহ গ্রহণ করলে তা হয় ইত্তেবা। আভিধানিক অর্থে ইত্তেবা হচ্ছে পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থে  শারঈ বিষয়ে কারো কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া। 
মুফতী আমিমুল ইহসান বলেন,
তাকলীদ বলা হয় কোন ব্যক্তিকে দলীল-প্রমাণ ছাড়া তাকে অনুসরণ করা। এবং কোন প্রমাণ ছাড়াই তার অনুসরণ করা। মূল কথা হল যে ব্যক্তি কুরআন-হাদীস ইজমার ভিত্তিতে দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলীর সমাধান দিতে সক্ষম নন এমন ব্যক্তির জন্য কুরআন-হাদীস,ইজমার আলোকে সমস্যার সমাধানকারী ইমামের অনুসরণ করা হল তাকলীদ।আমরা তাকলীদ বলতে সহজ ভাষায় মাযহাবের অনুসরণকে বুঝে থাকি।

তাকলীদের গুরুত্ব

রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
আমার উম্মতের একটি দল থাকবে যারা সর্বদা সত্যের উপর থাকবে এবং তাদেরকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না।
অর্থাৎ, রাসূলে পাক(সাঃ) এই বিষয়টি তার উম্মাতকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, এই উম্মাত কখনও বিভ্রান্ত ও বিপদগামী হবে না। এই উম্মতের ভিতর থেকে দ্বীনী শিক্ষা কখনও সরে যাবে না। আর সে জন্য তাদের মধ্যকার অনবরত ফিকহচর্চ্চা অব্যাহত থাকবে।এরই আলোকে ইসলামী ফিকহ সংকলন করা হয়।এই ফিকহশাস্ত্র সংকলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

সাতটি কারণে ইসলামী ফিকহ সংকলন করা হয় যা হলঃ

১। কুরআনে কোন কোন বিষয়ে কেবলমাত্র মূলনীতিসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু তার বিস্তারিত কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নাই।বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়া কখনও তা আমাদের পক্ষে উপলব্দ্বি করা সম্ভব নয় তা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে।তাই এরজন্য ফিকহ সংকলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
২। কুরআনের কোন কোন স্থানে পরস্পর বিপরীতমুখী আয়াত দেখা যায়।যেমন আল্লাহ এক জায়গায় ইরশাদ করেন,
আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে [বাকারাঃ২৩৪]
আবার অন্যস্থলে তিনি বলেন,
তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তানপ্রসব পর্যন্ত।  [তালাকঃ৪]
এই সকল বিষয়ের সমাধান ফিকাহ শাস্ত্রে রয়েছে।
৩। কখনও কখনও কুরআন-হাদীসে বাহ্যিক সংঘর্ষ দেখা যায়।যেমন আল্লাহ বলেন,
কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। [মুজাম্মিলঃ২০]
আবার হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে,
সুরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।
এই সংকট নিরসনে ফিকহের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম
৪। মাঝে মধ্যে পরস্পর বিরোধী হাদীসের মধ্যকার সঠিক সমাধানের জন্য ফিকহের প্রয়োজনীয়তা আছে। এক হাদীসে বলা হয়েছে,
সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না।
আবার অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে,
ইমামের কিরআত হল মুক্তাদীর কিরাআত।
এখন জামাআতের সাথে সালাত আদয় করলে কি কিরাআয় তিলওয়াত করতে হবে কি হবে না তার সমাধানের জন্য ফিকাহচর্চ্চা করতে হবে।
৫। কুরআন-হাদীসে একাধিক অর্থবোধক শব্দাবলী রয়েছে যা সামঞ্জস্য বিধানের দাবী রাখে।অন্যথায় কুরআন-হাদীসের উপর আমল করা দুষ্কর হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,
আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন কুরু পর্যন্ত।  [বাকারাঃ২২৮]
এখানে কুরুহ শব্দের দ্বারা দুটি অর্থ ইঙ্গিত করা হয় যার একটি হল পবিত্রতা ও অপরটি হল অপবিত্রতা।এখানে কোন অর্থে তা ব্যবহৃত হবে তার সমাধানের জন্য ফিকহশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
এক হাদীসে বলা হয়েছে, যে বর্গাচাষ বর্জন করে না, সে যেন আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ব যুদ্ব করে।
অপর এক হাদীসে এসেছে,
সব ধরনের বর্গাচাষ অবৈধ নয়।
৬। স্থান,কাল ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়।ইসলাম যেহেতু,পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা তাই এই কারণে তা কুরআন-হাদীস মোতাবেল সমাধান হওয়া উচিৎ।যেমনঃ মানব ক্লোনিং,শেয়ার ব্যবসা ইত্যাদি।
৭। আরবী ভাষার দক্ষতা সমানভাবে থাকলেও কুরআন-হাসদীসের জ্ঞানে তা থাকে না।অথচ কুরআন-হাদীস থেকে মাসালা বের করার জন্য আরবী ভাষা জানার পাশাপাশি কুরআনের শানে নূযুল,হাদীসের শানে উরুদ,মুহকাম,মুতাশাবিহাত,আম-খাস,মুজমাল,মুফাসসাল,ছরী-কিনায়া,নাসিখ-মানসুখ,রিজালশাস্ত্র,জারাহ তাদীল ইত্যাদি ধরনের জ্ঞান রাখা দরকার।
আব্দুল গনী নাবলূসী(রঃ)  বলেন,
যেসকল বিষয়ে শরীয়াতে কোন মতবিরোধ নেই এবং স্পষ্টভাবে জ্ঞাত,সেসব বিষয়ে চার ইমামের অনুসরণ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।যেমনঃ সালাত,যাকাত,সাওম, হাজ্জ যা ফরয আর ব্যভিচার,সমকামিতা,শরাব পান,হত্যা,চুরি ইত্যাদি হারাম।
আল্লামা খতীবে বাগদাদী বলেন,
শরীয়াতের আহকাম দুই ধরনের। অধিকাংশ আহকাম দ্বীনের অংশ হিসেবে বিবেচিত। যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমযানের সিয়াম, যাকাত ও হাজ্জ ইত্যাদির অপরিহার্যতা এবং মদ,যিনার নিষিদ্বতা। এজন্যে কারও তাকলীদ করা বৈধ নয়। এগুলো সকলের জন্য সমান বোধগম্য।অন্যদিকে ইবাদত,মুয়ামালাত, মুয়াশারাত,বিবাহের জন্য তাকলীদের প্রয়োজনীয়া অপরিসীম। কারণ কুরআনে বলা হয়েছে, তোমাদের ইলম না থাকলে ইলমদের কাছে জিজ্ঞাসা কর। আর এই সকল তাকলীদ নিষিদ্ব হলে সকলকে বাধ্যতামূলক ইলম চর্চায় নিয়োজিত হতে হবে এবং এতে করে স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার মান অচল হয়ে পড়বে।
মাওলানা আশরাফ আলী থানবী(রঃ) বলেন,
মাসালা তিন ধরনের যার ভিতর একধরনের মাসালার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে প্রকাশ্য সংঘর্ষ আছে। ২য় ধরনের মাসালার ব্যাপারে সংঘর্ষ না থাকলেও সেখানে একাধিক অর্থ থাকতে পারে।আর কিছু কিছু মাসাআলা আছে যা সকলের জন্য অনুধাবন করা অত্যন্ত সহজ।
এখানে এটি বলা-বাহুল্যে যে, প্রথম দুই ধরনের মাসালা সাধারণ লোকের জন্য অনুসরণ করা কঠিন হলেও শেষোক্ত মাসালা অনুসরণ করা কারও জন্য কষ্টসাধ্য নয়। তাই প্রথম দুই শ্রেণীর মাসালার সমাধানের জন্য তাকলীদ করা অপরিহার্য একটি বিষয়।

তাকলীদের উপমা

মাওলানা কাসিম নানুতবী(রঃ) তাকলীদের উপমা প্রদান করতে গিয়ে এইভাবে তার মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, যদি কোন মুর্খ লোক যদি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজেই যদি নিজের চিকিৎসা করে তাহলে কি তাকে কেউ বুদ্বিমান বল্বে?তাকে সকলে আহম্মক বলবে। তেমনিভাবে তাকলীদ সেভাবে করা উচিৎ।

তাকলীদের প্রকারভেদ

তাকলীদ দুইভাবে হতে পারেযা হল তাকলীদ মুতাল্লাক আরেকটি হল তাকলীদে শাখাসী।যেই ধরনের তাকলীদে কোন মাসালার ব্যপারে এক ইমামের অনুসরণ করা হয় আবার অন্যান্য মাসালার সমাধানের জন্য আরেক ইমামের অনুসরণ করা হয় তা হল তাকলীদে মুতাল্লাক।আর যেই ধরনের তাকলীদে সকল মাসালার জন্য একজন ইমামের অনুসরণ ধর্তব্য সেই ধরনের তাকলীদ হল তাকলীদ শাখাসী।

হুকুম

তাকলীদ করা ওয়াজিব। তাকলীদ বিরোধীগণ এই ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যকার মতভেদ এখানে এই যে,   তাকলীদে মুতাল্লাক করা ওয়াজিব কিন্তু তাকলীদে শাখাসীর জন্য তার কোন দরকার নেই। কিন্তু তা বর্তমানে এই ফিৎনার যমানার জন্য তাকলীদে শাখাসী করা উত্তম।কারণ তা না হলে লোকেরা দ্বীনকে নফস বা রিপুর অনুসারী করে ফেলবে।যখন যেই ইমামের যেই কাজটি নিজের নফসের অনুগামী বলে মনে হবে সেটি সে করতে বাধ্য হবে। তাই তাকলীদে শাখাসী ওয়াজিব।এই ব্যাপের নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান লিখেছেন,
তাকলীদে শাখাসী হিজরীর ২য় শতকের সময় থেকে শুরু হয়। এবং তা করা সেই সময়এ ওয়াজিব ছিল।
যেহেতু তাকলীদে মুতাল্লাকে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী থাকে তাই তাকলীদে শাখাসী করাই উত্তম।        
কুরআনে তাকলীদ
তাকলীদ যে ওয়াজিব, এটা কুরআনের আয়াত, সহীহহাদীছ, উম্মতের কর্মপন্থা ও তাফসীরকারকদের উক্তি সমূহ থেকে প্রমাণিত। সাধারণ তাকলীদ হোক বা মুজতাহিদের তাকলীদ হোক উভয়ের প্রমাণ মওজুদ রয়েছে। (নিম্নে ওগুলো উপস্থাপন করা হল।)
১ম আয়াত
আল্লাহ বলেন,
 আল্লাহর আনুগত্য কর, তাঁর রসুলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা আদেশ প্রদানকারী রয়েছে, তাদেরও। [নিসাঃ৫৯]
এ আয়াতে তিনটি সত্বার আনুগত্যের নির্দেশ  দেয়া হয়েছে- (১) আল্লাহর (কুরআনের) আনুগত্য, (২) রসুলের (হাদীছের) আনুগত্য এবং (৩) আদেশ দাতাগণের (ফিকহাবিদ মুজতাহিদ আলিমগণ) আনুগত্য। লক্ষ্যণীয় যে, উক্ত আয়াতে- اَطِيْعُوْا (আতীউ) শব্দটি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহর জন্য একবার এবং রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও আদেশ প্রদানকারীদের জন্য একবার। এর রহস্য হলো আল্লাহ যা হুকুম করবেন, শুধু তাই পালন করা হবে, তার কর্ম কিংবা নীরবতার ক্ষেত্রে আনুগত্য করা যাবে না। তিনি কাফিরদেরকে আহার দেন, কখনও কখনও তাদেরকে বাহ্যিকভাবে যুদ্ধে জয়ী করান। তারা কুফরী করলেও সাথে সাথে শাস্তি দেন না। এ সব ব্যাপারে আমরা আল্লাহকে অনুসরণ করতে পারি না। কেননা এতে কাফিরদেরকে সাহায্য করা হয়। কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও মুজতাহিদ ইমামের প্রত্যেকটি হুকুমে, প্রত্যেকটি কাজে, এমন কি যে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁরা নীরবতা অবলম্বন করেন, সে সমস্ত ক্ষেত্রেও তাদের আনুগত্য করা যায়। এ পার্থক্যের জন্য اَطِيْعُوْا শব্দটি দুবার ব্যবহৃত হয়েছে। যদি কেউ বলে اُوْلِى الْاَمْرِ (উলীল আমর) দ্বারা ইসলামী শাসন কর্তাকে বোঝানো হয়েছে, এতে উপরোক্ত বক্তব্যে কোন রূপ তারতম্য ঘটবে না। কেননা শুধু শরীয়ত সম্মত নির্দেশাবলীতেই শাসনকর্তার আনুগত্য করা হবে, শরীয়ত বিরোধী নির্দেশাবলীর ক্ষেত্রে আনুগত্য করা হবে না। ইসলামী শাসনকর্তা হচ্ছেন কেবল হুকুম প্রয়োগকারী। তাঁকে শরীয়তের যাবতীয় আহকাম মুজতাহিদ আলিমগণের নিকট থেকে জেনে নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, আসল আদেশ প্রদানকারী হচ্ছেন ফিকহবিদ।আবূ বকর জাসসাস,নওয়াব সিদ্দিক হাসানসহ অনেক মুফাসসিরিনগণ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, এর দ্বারা ফকীহবিদগণকে বুঝানো হয়েছে।হযরত ইমাম আবু হানিফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মাযার শরীফ
ইসলামী সুলতান ফিকহবিদ আলিমের বর্ণিত অনুশাসন জারী করেন মাত্র। সমস্ত প্রজাদের হাকিম বাদশাহ হলেও বাদশাহের হাকিম হচ্ছেন মুজতাহিদ আলিম। শেষ পর্যন্ত اُوْلِى الْاَمْرِ (উলিল আমর) হলেন মুজতাহিদ আলিমগণই। اُوْلِى الْاَمْرِ (উলীল আমর) বলতে যদি কেবল ইসলামী বাদশাহ ধরে নেয়া হয়, তাতেও তাকলীদ প্রমাণিত হয়। আলিমের না হলেও অন্ততঃ বাদশাহের তাকলীদতো প্রমাণিত হয়। মনে রাখতে হবে যে, এ আয়াতে আনুগত্য বলতে শরীয়তের আনুগত্য বোঝানো হয়েছে।এ ধরনের অনুশাসন মেনে চলার জন্য اُوْلِى الْاَمْرِ مِنْكُمْ (উলীল আমরে মিনকুম) বলা হয়েছে। এ তিন রকম শরীয়ত বিধির জন্য তিনটি আদেশ দেয়া হয়েছে।
২য় আয়াত
 (হে লোক সকল! তোমাদের যদি জ্ঞান না থাকে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর।)  আম্বিয়াঃ৭
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল যে, যে বিষয়ে অবহিত নয়, সে যেন সে বিষয়ে জ্ঞানীদের নিকট থেকে জেনে নেয়। যে সব গবেষণালব্ধ মাসাইল বের করার ক্ষমতা আমাদের নেই, ঐগুলো মুজতাহিদগনের নিকট থেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হবে। কেউ কেউ বলেন যে, এ আয়াতে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী জেনে নেয়ার কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে, এর পূর্ববর্তী আয়াত থেকেও এটাই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়। কেননা এ আয়াতের শব্দগুলো বিশেষিত বা শর্তযুক্ত নয়। আর না জানাটাই হলো জিজ্ঞাসা করার মূল কারণ। সুতরাং যে বিষয়ে আমরা জানি না, সেটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা একান্ত প্রয়োজন। তাফসীরে রুহুল মাআনী প্রণেতা, আল্লামা খতীব বাগদাদীসহ অনেকে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, এই আয়াতের দ্বারা মাযহাব অনুসরণের কথা বলা হয়েছে।
৩য় আয়াত
আল্লাহ বলেন,
প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একটি ক্ষুদ্র দল কেন বেরিয়ে পড়ে না?তারপর তারা জ্ঞান শিখবে এবং তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসে তাদের শিক্ষা দিবে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। [তওবাঃ১২২]
এই আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী উম্মাহের ভিতর এমন একটি দল থাকবে যারা দিন-রাত ইলম অর্জনের জন্য ব্যস্ত থাকবে এবং প্রয়োজনীয় ইলম বঞ্চিত মুসলিমগণকে দান করবে। এই আয়াতের তাফসীরের ব্যাপারে আবূ বকর জাসসাস বলেন,
এ আয়াতের দ্বারা আলিমগণকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে এবং সর্বসাধারণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
৪র্থ আয়াত
আল্লাহ বলেন,
 (যিনি আমার দিকে (আল্লাহর দিকে) রুজু করেছেন তার পদাঙ্ক অনুসরন কর।)
এ আয়াত থেকে এও জানা গেল যে আল্লাহর দিকে ধাবিত ব্যক্তিবর্গের অনুসরণ (তাকলীদ) করা আবশ্যক। এ হুকুমটাও ব্যাপক, কেননা আয়াতের মধ্যে বিশেষত্ব জ্ঞাপক কোন কিছুর উল্লেখ নেই।
এবং তাঁরা আরয করেন- হে আমাদের প্রভু! আমাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের দ্বারা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দাও এবং আমাদেরকে পরহেযগারদের ইমাম বানিয়ে দাও।
তাফসীরে মাআলিমুত তানযীলে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ যাতে আমরা পারহেযগারদের অনুসরণ করতে পারি, আর পারহেযগারগণও আমাদের অনুসরণ করার সুযোগ লাভ করতে পারেন। এ আয়াত থেকেও বোঝা গেল যে, আল্লাহ ওয়ালাদের অনুসরণ বা তাকলীদ করা একান্ত আবশ্যক।
 (সুতরাং এমন কেন করা হয় না যে তাদের প্রত্যেক গোত্র হতে একটি দল ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণের জন্য বের হয়ে পড়তো এবং ফিরে এসে নিজ গোত্রকে ভীতি প্রদর্শন করতো। যাতে গোত্রের অন্যান্য লোকগণ মন্দ, পাপ কার্যাবলী থেকে দুরে সরে থাকতে পারে।
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল প্রত্যেকের মুজতাহিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ ফিকহবিদ হবেন, অন্যরা কথায় ও কর্মে তাঁদের অনুসরন  করবে।
৫ম আয়াত
আল্লাহ বলেন,
(যে সকল মুহাজির এবং আনসার অগ্রগামি যারা প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে যারা সৎ উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তীদের অনুগামী হয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও তার (আল্লাহর) প্রতি সন্তুষ্ট।)
বোঝা গেল যে, যারা মুহাজির ও আনসারগণের অনুসরণ বা তাকলীদ করেন, আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট। এখানেও তাকলীদের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।

হাদীসের আলোকে তাকলীদ

আল-কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের আলোকে তাকলীদের প্রমাণ করা যায়।এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস রয়েছে। তবে আলোচনার স্বার্থ এখানে সীমিত সংখ্যক কিছু হাদীস উল্লেখ করা হলঃ
১ম হাদীস
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
আমি জানি না আমি তোমাদের মাঝে আর কতদিন জীবিত থাকব।তবে আমার পরে আবূ বকর ও উমর এর ইকতিদা করবে। [তিরমিযী]
বলা বাহুল্য এখানে যেই ইকতিদার কথা বলা হয়েছে, তা প্রশাসনিক অর্থে নয় বরং তা দ্বীনী শরীয়াতের বিষয়ে আনুগত্যকে বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
[আনআমঃ৯]
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর ওফাতকালীন সময়ে সালাত সম্পর্কে বর্ণিত আছে,
আবূ বকর(রা:) ইক্তিদা করেছিলেন রাসূল্ললাহ(সাঃ) এর আর আবূ বকর(রাঃ) এর ইক্তিদা করেছিলেন সকলে। [বুখারী ও মুসলিম]
এভাবে করে অসংখ্য হাদীসে ইক্তিদার কথা এভাবে বলা হয়েছে। আর এই ইকদিতা হল তাকলীদ।
২য় হাদীস
 রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
আল্লাহ পাক তোমাদের ভিতর থেকে ইলম ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন না। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে আগে আলিম উঠিয়ে ফেলবেন। এরপর তোমাদের মাঝে আলিম বলতে আর কেউ থাকবে না। তারপর তোমরা মূর্খ লোকদের মর্যাদা দান করবে। তারা তোমাদের ভুল ফাতওয়া দান করবেন এবং তারা নিজেরাও গোমরাহী হবে এবং অন্যদের করবে। [বুখারী,মুসলিম]
আলোচ্য হাদীসে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফাতওয়া প্রদানকে অন্যতম পবিত্রতর ধর্মীয় কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই এটা সকলের দায়িত্ব যে, তারা সাধারণভাবে আলিমের ফাতওয়ার তাকলীদ করবে।
৩য় হাদীস
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
পরিপক্ক ইলম ছাড়া ফাতওতা প্রদান করলে তার পাপ ফাতওয়াকারীর উপর বর্তাবে। [আবূ দাউদ]
এই হাদীসটি তাকলীদের সপক্ষে একটি বড় দলীল।যাদের ইলমের ব্যাপারে সম্মত ধারনা নেই তাদের জন্য নিজে হাদীস বুঝে ফাতওয়া প্রদান করা জায়েয নয়। কারণ তাহলে তার পাপ ফাতওকারীর উপর পড়বে।এই হাদীসের এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, যেকোন জাহেল লোককে কোন বিজ্ঞ আলিমের কাছে থেকে ফাতওয়া জানতে হবে। যদি সেই আলিম ভুল ফাতোয়া প্রদান করে তাহলে তার পাপ আলিমের হবে প্রশ্নকারীর নয়।
৪র্থ হাদীস
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
যে দ্বীনের ব্যাপারে তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী সে তার দিকে তাকাবে আর তার অনুসরণ করবে আর পার্থিব বিষয়ে যে তোমার চেয়ে নিম্নে তার প্রতি তাকাবে এবং আল্লাহর প্রশংসা করবে। [আহমদ]
এই হাদীস থেকে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, যারা দ্বীনের ব্যাপারে উপর থাকবে তাদের অনুসরণ করা কেবল বৈধ নয় বরং তা আল্লাহ ও রাসূলের কাছে অতি পছন্দনীয় একটি কাজ।
৫ম হাদীস
একবার এক মহিলা এসে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর কাছে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার স্বামী জিহাদে গিয়েছেন।তিনি থাকতে আমি তার সালাত ও অন্যান্য কাজ অনুসরণ করতাম।এখন তার ফিরে আসা পর্যন্ত এমন কোন আমলের কথা বলে দিন যা তার আমলের মর্যাদায় পৌছতে পারবে।
এই হাদীসে দেখা যাচ্ছে এই মহিলা তার স্বামীর সালাতসহ অন্যসব আমলের ইক্তিদা করেছেন কিন্তু মুহাম্মদ(সাঃ) তার প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করেন নাই।
৬ষ্ঠ হাদীস
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) ইরশাদ করেন,
তোমরা আমার ইকতিদা কর আর পরবর্তীতে তোমাদের দেখে ইকতিদা করবে। [বুখারী,মুসলিম]
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা হাফিয বিন হাজার বলেন,
এর দ্বারা অনেকে এটা মনে করেন যে, তোমরা আমার কাছ থেকে শরীয়াতের আহকাম শিখে রাখো,কেননা পরবর্তীরা তোমাদের কাছত এহেকে এবং আরও পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে শিখবে। আর এই ধারা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।
সাহাবাদের যুগে তাকলীদ
সাহাবাদের যুগে তাকলীদ সংঘটিত হয়।এর বেশ কয়েকটি নজীর রয়েছে। সেই সকল নজীরসমূহ নিম্নে দেওয়া হলঃ
১ম নজীর
জাবিয়া নামক স্থানে হযরত উমর(রাঃ) একবা খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন, হে লোকসকল! কুরআনের ইলমুল কিতাবের ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে তোমরা উবাই ইবন কাব,ফারায়েয সম্পর্কে যায়দ বিন সাবি(রাঃ),ফিকাহের ব্যাপারে মুআয বিন জাবাল(রাঃ) এবং অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কাছে আসবে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, উমর(রাঃ) কুরআন,ফারায়য,ফিকাহশাস্ত্রের জন্য পৃথক পৃথক ব্যক্তিকে তিনি নির্বাচিত করে তাদের অনুসরণ করতে বলেন।
২য় নজীর
সালিম বিন আব্দুল্লাহ বলেন,
ইবন উমর(রাঃ) ইয়মামের পিছনে কিরাআত করতেন না। কিন্তু তিনি একবার মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে কিরাআত করতে পার আবার নাও পার।
এই নজীর হতে এই বিষয়টি জানা যায় যে, একটি মাসালার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মতামত থাকতে পারে।
৩য় নজীর
বুখারী শরীফে একটি হাদীস এসেছে,
একবার মদীনাবাসী হযরত ইবন আব্বাস্কে একবার মাসাআলা জিজ্ঞাসা করল। তাওয়াফ অবস্থায় মহিলার ঋতুস্রাব হলে কি করবে? ইবন আব্বাস বলেন, সে ঐ অবস্থায় সে ফিরে আসবে। তখন মদীনাবাসী বলল আমরা আপনার কথা মানতে গিয়ে যায়দ ইবন সাবিতকে কেনই বা বিসর্জন দিব?
উক্ত হাদীস থেকে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবাদের যুগে মদীনাবাসীগণ যায়িদা ইবন সাবিত(রাঃ) এর তাকলদী করতেন।আর আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রাঃ) তাদেরকে যায়দ ইবন সাবিত(রাঃ) এর তাকলীদ করতে নিষেধও করেন নাই।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায় যে, তাকলীদ করা শরীয়াতের একটি অপরিহার্য অংশ। একে অস্বীকার করার কোন অবকাশ।তাই আমরা ইসলামী শরীয়াতকে সঠিকভাবে উপলব্দ্বি করার জন্য নির্দিষ্ট যেকোন একজনের তাকলীদ করার জন্য চেষ্টা করব।  



No comments:

Post a Comment

৩৮ তম বিসিএস এর রেজাল্ট

৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এ কথা নিশ্চিত করেন। ...