কিয়াস
জগৎ
পরিবর্তনশীল।যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনের পরিবর্তন ঘটে। দেখা যায়
নতুন সমস্যা।এসকল নতুন নতুন সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায় তার সমাধানের জন্য
ইজতিহাদের ব্যবস্থা আছে। আর এর নাম হল কিয়াস। কিয়াস শরিয়াতের একটি অন্যতম
প্রধান উৎস।একে ইসলামের ৪র্থ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।কিয়াসের অর্থ হল অনুমান
করা,পরিমান করা,তুলনা করা,ওজন করা,নমুনা ,সাদৃশ্য করা ইত্যাদি।
মানার
গ্রন্থাগার বলেন, “হুকুম ও ইল্লতের বিবেচনায় মূল এর আদলে
শাখা এর স্বরুপ নির্ণয় করা”।
ফিকহবিদগণ
বলেন, “কিয়াস হল যে বিষয় হুকুম নেই সেই বিষয় হুকুম
প্রতিষ্ঠা করা।”
তানযীহ
গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, “হুকুমের মূল শাখার দিকে স্থানান্তরিত হল
কিয়াস।”
মালিকিগণ
বলেন, “মূল আইন হতে ইল্লাতের যুক্তিভত্তিক
সিদ্বান্ত হল কিয়াস।”
শাফিঈগণ
বলেন, “একটি পরিচিতি জিনিসের সাহতে অন্য একটি
পরিচিতি জিনিসের ইল্লাতের মাধ্যমে সম্বনয় সাধন হল কিয়াস।”
মুহাম্মদ
তাকী আমিনী বলেন, “হুকুম এবং ইল্লাতের বিবেচনায় মূল এর আদলে শাখা এর স্বরুপ
নির্ণয় হল কিয়াস।”
ইমাম
আবূ হানীফা(রঃ) এর মতে, “কিয়াস হল আইনের বিস্তৃতি।মূল আইন যখন
সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বলতে পারে না,তখন মূল আইন হতে ইল্লাতের মাধ্যমে নতুন
বিধি আহরন করতে হয়,এখানে আইনের যে বিস্তৃতি হয় ইয়া হল কিয়াস।”
অর্থাৎ,
আমরা বলতে পারি যে,কিয়াস শরীয়াতের এমন উৎস যার সাহায্যে কুরআন-হাদীসের আলোকের কোন
নতুন কোন বিষয় সমাধান দেওয়া হয়।
দলীল
কিয়াস
যে শরীয়াতে অন্যতম প্রধান উৎস তা কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ পাক
বলেন,
“অতএব, হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ, তোমরা
শিক্ষা গ্রহণ কর।” [হাশরঃ২]
আল্লাহ
এখানে বলছেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর এর ব্যাখ্যায় ফকীহগণ বলেন,
কোন
ব্যাপারকে তার নজীর বা সাদৃশ্যের সাথে যুক্ত করে সাদৃশ্যের হুকুমটি প্রতিষ্ঠা করতে
হবে এবং এর বেলায়েও সেই হুকুমটি প্রয়োগ করা।
আয়াতে
শিক্ষা গ্রহণের দ্বারা উদ্ভাবনের আদেশ দেওয়া হয়েছে যাকে কুরআনে তাযাক্কুহ বলা
হয়েছে।
এছাড়াও
কিয়াসের ভিত্তি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মুহাম্মদ(সাঃ) যখন মুয়াজ ইবনে জাবাল(রাঃ)কে
ইয়ামেনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন মুহাম্মদ(সাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা
করেছিলেন যে,কি দিয়ে তুমি বিচার করবে?তিনি উত্তরে বললেন, “আল্লাহের কিতাবেরর দ্বারা করব।” তখন মুহাম্মদ(সাঃ) বললেন, “যদি কুরআনেও যদি তার সমাধান না পাও তাহলে
তার সমাধান কীভাবে করবে?” তখন মুয়াজ(রাঃ) বললেন, “হাদীসের দ্বারা।” তখন মুহাম্মদ(সাঃ)বললেন যদি তার সমাধান
হাদীসে না পাও তখন কি করবে?তখন সে উত্ততে বললেন, আমি তা আমার বিবেকের সাহায্যে
সমাধান করব”। তার এই জবাব শুনে মুহাম্মদ(সাঃ)
সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন আর আল্লাহের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
উমর(রাঃ)
একবার আবূ মূসা আশআরী (রাঃ)কে বলছিলেন,
“সাদৃশ্যপূর্ণ ও পরস্পর তুলনাযোগ্য বিষয়দি
চিনতে ও জানতে চেষ্টা কর এবং তোমার সামনে উপস্থিত বিষয়ইয়াদী তার উপর রেখে বিবেচনা
কর।”
কিয়াসকে
বিরোধিতা করার কোন সুযোগ নেই।তবে কোন কোন সম্প্রদায় কিয়াসের ঘোর বিরোধিতা করে
থাকে।শিয়া,খারিজি ও যাহেরি সম্প্রদায়ের লোকেরা কিয়াসের বিরোধিতা করে থাকে।তারা
কিয়াসের বিরোধিতা করার জন্যে নিম্নোক্ত আয়াত আর হাদীসসমূহ তুলে ধরে। যেমনঃ আল্লাহ
বলেন,
“সমস্ত ব্যাপারে বর্ণনা প্রদানের জন্য আমি
তোমার প্রতি ক্তাব নাযিল করেছি।” [নহলঃ৯১]
“প্রতিটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে কিতাবে আছে।” [আনআমঃ৫৯]
রাসূল(সাঃ)
বলেন, “বনী-ইসরাইল অনেকদিন পর্যন্ত সঠিক পথের উপর
ছিল।যখন যুদ্ব বন্দীদের সন্তানের আধিক্য হল এবং তারা আগত বিষয়ের উপর কিয়াস করা
শুরু করল সেসময় হতে তারা নিজেরা গোম্রাহ হল এবং আর অন্যদেরও গোমারাহ করল।”
পারতপক্ষে
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসের দ্বারা কিয়াসকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় নাই।উপরোক্ত আয়াতদ্ব্য়ের
দ্বারা এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ পাক কুরআনে সকল সমস্যার সমাধান
দিয়েছেন।কুরআনের ভিতর যেসকল হুকুম রয়েছে তা বিদ্যমান থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত।কিন্তু
এর উপর চিন্তা-গবেষণা করতে আল্লাহ নিষধ করেন নাই।কারন আল্লাহ নিজেই বলেছেন, “তারা এর উপর কেন চিন্তা গবেষণা করে না।”তাই অভিজ্ঞবিদগণ বলেছেন, “কুরআনে বিস্ময়কর বিষয়য়াদীর অন্তর্নিহিত
তাৎপর্য ও গভীর তত্ত্বের কোন দিন পরিসমাপ্তি ঘটবে না।”
অন্যদিকে
হাদীসের দ্বারা যে বিষয়ের প্রতি ইংগিত দেওয়া হয়েছে তা হল এই যে, কিয়াসের ক্ষেত্রে
অধিক সাবধানতা অবলম্বণ করতে হবে।তা না হলে পূর্ববর্তীদের ন্যায় গোমরাহী হতে
হবে।সাহাবাগণ ইজমার দ্বারা কিয়াসের বৈধতার প্রমাণ পাওয়া যায়।সাহাবাগণ কিয়াসের সময়
ব্যাপক শর্তকতা অবলম্বন করতেন।
রুকন
কিয়াসের রুকন চারটি।তা হল
১.আল
আসলু (মূল): এটি
হল কিয়াসের প্রধান ও মূল বিষয়। নতুন উদ্ভাবিত বিষয়টিকে যেটির সাথে তুলনা করা হয়
সেটি হল আল আসলু বা মূল। এটি একটি কুরআনের আয়াত অথবা হাদীস অথবা গ্রহণযোগ্য ইজমা
হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
২.ফারযা
(শাখা):এটি
হল শাখা বিধান। যেইসকল সমস্যাসমূহের সমাধান কুরআন-হাদীস,ইজমাতে পাওয়া যায় নাই
তাদেরকে ফারযা বলা হয়।এই ফারযা কিয়াসের মূল বা আল-আসলুর সাথে তুলনীয়।
৩.ইল্লাত
(কারণ): ইল্লত
অর্থ হল কারণ বা যুক্তি। কিয়াসের রুকন হল ইল্লতুল জামিয়া বা সমন্বিতকরণ। অর্থাৎ,
যে কারণ বা যুক্তির ভিত্তিতে মূল-বিধান থেকে তা শাখাবিধানে বর্তমান থাকে।
৪.হুকুম
(বিধান): আসলুর
ইল্লত বা ফরযা বা শাখার মধ্যে বিদ্যমান থাকার প্রেক্ষিতে আসলুর হুকুম ফরযার ভিতর
স্থানান্তরিত করার ফলে নতুন সমস্যার যে সমাধান পাওয়া যায় তাই হল হুকুম।
এখানে
যেসকল রুকুনসমূহ ইল্লাতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় তার ভিতর ইল্লাত সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন
আল্লাহ বলেন,
হে
মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ,জুয়া,প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারণ করা শয়তানের কাজ।তোমরা এগুলো
পরিহার কর যাতে তোমরা সফলকাম হও। [মায়িদাঃ৯০]
আল্লাহ
অন্যত্র বলেন,
তোমরা
ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না, নিশ্চয় এটা অশ্লীল বা পাপ কাজ। [বনী-ঈসরাইলঃ১৭]
এখানে
মদ এবং ব্যভিচারকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে যাকে আসলু বলা যায়।এরপর এখনকার যুগে
হিরোইন,গাজা,আফিমসহ অনেক মাদকদ্রব্য আবিষ্কারিত হয়েছে।তারপর সমকামিতার ব্যাপারে
কুরআন-হাদীসে তেমনকিছু উল্লেখ করা হয় নাই। এইসব ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের ভিতর কোন
সঠিক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় না।কিন্তু পরবর্তীতে মুজতাহিদ্গণ চিন্তা-গবেষণা ও
ইল্লতের মাধ্যমে এটি আবিষ্কার করলেন যে, হিরোইন,গাজা,আফিম ইত্যাদি মদের ন্যায় একটি
খারাপ ও জঘন্য কাজ যা মানুষের ভিতর নেশার উদ্রেক সৃষ্টি করে তাই তা মদের ন্যায়
হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে সমকামিতা ব্যভিচারের মত একটি অশ্লীল ও
পাপপূর্ণ একটি কাজ।তাই এটি ব্যভিচারের মত হারাম। অর্থাৎ, আমরা এখানে
গাজা,হিরোইন,আফিম এবং সমকামিতা হালাল না হারাম সেই প্রশ্নের মাধ্যমে যেই উত্তর
পেলাম তা শরীয়াতের বিধান হিসেবে গণ্য করা হবে।
কিয়াসের আওতা ও পরিধি
কিয়াসকে
হানাফীগণ সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে।তারা কোন কোন ক্ষেত্রে কিয়াসকে আহলে ওয়াহিদের
উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা কিয়াসের গুরুত্বের কথা বুঝাতে গিয়ে নিমোক্ত আয়াতকে সবার
সামনে তুলে ধরে।আল্লাহ বলেন,
“তাদের হৃদ্বয় থাকা সত্ত্বেও তারা অনুধাবন
করে না,চোখ থাকা সত্ত্বেও তারা দেখে না,কান থাকা সত্ত্বেও তারা শুনে না। তাদের
অবস্থা হল সেরকম পশুর মত যারা জ্ঞান-বুদ্বিহীন।”
অন্যদিকে
ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের অভিমত হল কেবলমাত্র প্রয়োজন দেখা দিলে কিয়াসের সাহায্য
নেওয়া যাবে।অন্যথায় যাবে না।অন্যদিকে ইমাম মালিক(রঃ) ও শাফিঈ(রঃ) কিয়াসের ব্যাপারে
মধ্যমনীতি অবলম্বন করেছেন। অন্যদিকে যাহিরী মতবাদের অনুসারীগণ সাধারণভাবে কিয়াসের
মতামতকে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে।
কিয়াসের
শর্তসমূহ
কিয়াস
সকলের কাছে প্রযোজ্য হওয়ার জন্য কিছু শর্তাদী পূরণ করতে হবে। তা না হলে তা কিয়াসের
আওতা বহির্ভূত হবে। কিয়াস বৈধ হওয়ার জন্য যেইসকল শর্তসমূহ পূরণ করতে হবে তা হল
নিম্নরুপঃ
১.
আসল নির্দিষ্ট না হওয়াঃ যেই বিষয়টি আসল হবে তা যেন নির্দিষ্ট অর্থাৎ খাস না হয়
সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আম বিষয়ের উপর ইজমা করা যায়। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
খুযায়মার জন্য কেবল একজনের সাক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।কিন্তু সাক্ষ্য গ্রহণের
জন্য কমপক্ষে দুইজন পুরুষ সাক্ষীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু খুযায়মা যেখানে থাকবে
সেখানকার জন্য একজন সাক্ষী হওয়া ধর্তব্য বলে মতামত দেয়া হয়েছে। এই বিষয়টি কেবল
খুযায়মার জন্য খাস এবং এই বিষয়টিকে কিয়াসের মূল বিষয় হিসেবে ধরা যাবে না।
২.
মূল বিষয়ের কিয়াসবিরোধী না হওয়াঃ যেই বিষয়টির উপর কিয়াস হবে তা যেন মূল বিধানের
কিয়াসবিরোধী না হয়। কারণ আসল নিজেই কিয়াসবিরোধী হলে তার উপর কিয়াস করা যাবে
না। যেমনঃ রোযা অবস্থাট পানাহার করলে রোযা ভেঙ্গে যায়।কিন্তু ভুলক্রমে
পানাহার করলে রোযা ভাংবে না। এটা কিয়াসসম্মত নয়। রাসূল(সাঃ) এর বিশেষ নির্দেশে তা
প্রবর্তিত হয়। সেজন্যে তার উপর কিয়াস করা যাবে না।
৩.
আসল ও ফারযা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াঃ আসল এবং ফারযা যতক্ষণ পর্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না
ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়াস করা যাবে না। আসল ও ফাযরার ভিতর মিল থাকলে সেখানে কিয়াস হবে।
৪.
আসলের হুকুম স্থানান্তরিত হওয়াঃ ইমাম ফখরুদ্দীন বলেন, “কিয়াসের একটি শর্ত হল আসলের হুকুমটি ফারযার উপর প্রয়োগ
করতে হবে। কারণ, হুকুম স্থানান্তর ছাড়া কিয়াস কঠিন হয়ে যাবে”।
৫.
আসলের হুকুম পরিবর্তিত না হওয়াঃ আসলের হুকুম ফারযার উপর প্রয়োগের পর আসলের হুকুমটি
অপরিবর্তিত থাকতে হবে। আসলের হুকুম রদ-বদলের সম্ভাবনা থাকলে তার উপর কিয়াস হবে না।
৬.
আসলটি অন্য কোন আসলের ফারযা না হওয়াঃ যেই বিষয়টির উপর কিয়াস করা হবে তার আসলটি
অন্য ফারযার উপর প্রয়োগযোগ্য নয়।
No comments:
Post a Comment