Sunday, 25 August 2013

প্রশ্নঃ যিশু খৃষ্টের জীবনী লিখ কুরআনের আলোকে।


ভূমিকা

 

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল-কুরআন ঈসা (আঃ) সম্পর্কে জ্ঞানের একটি উৎস যা সাধারণ ভাবে অধিকাংশ খৃষ্টানেরই জানা নেই। আল-কুরআন আমাদেরকে তার সম্পর্কে শুধু ভালভাবে জানতেই সাহায্য করে না, উপরন্তু এই জানার মধ্য দিয়ে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকেও বৃদ্ধি করে। ঈসা (আঃ)-এর জন্মের প্রায় ৬শ বছর পর নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানি কিতাব কুরআন পাকে তাঁর জীবন ও শিক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা প্রদান করেছে। একত্ববাদীদের ধারণায় নবী জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপট রয়েছে, কুরআন সেই প্রেক্ষাপটে ঈসা (আঃ)-এর ভূমিকাকে স্থাপন করেছে। প্রকৃতপক্ষে কুরআন তাঁর সম্পর্কে যতটা জ্ঞাত করেছে, অন্য আর কোন সূত্র তা পারেনি।

 

 

 

আল-কুরআনে ঈসা(আঃ) এর নাম ২৫বার এবং তার মাতা মারিয়াম(আঃ) এর কথা ৩১ বার উল্লেখ করা হয়েছে।তার মা এর নামে এবং তার নানার নামে আলাদা দুটি সূরাহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।সূরাহ ইমরানে মারিয়াম(আঃ) এর গর্ভে অলৌকিকভাবে কীভাবে ঈসা(আঃ) জন্মগ্রহণ করেন তা তুলে ধরা হয়েছিল।



 

পবিত্র কুরআনে ঈসা (আঃ)-এর জীবন-কাহিনীর বিশদ বর্ণনা প্রদান করেনি, বরং সুনির্দিষ্ট কিছু ঘটনা ব্যক্ত করেছে। তাঁকে যে অলৌকিক ক্ষমতা ও শক্তি দেওয়া হয়েছিল তার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ ভাষায়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাঁর কাছে ইনজিল নামে যে আসমানি কিতাব নাযিল করেছিলেন বেশ কয়েকবার তার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু উক্ত কিতাবের সঠিক বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা হয়নি। যা হোক, তিনি কীভাবে পৃথিবীতে আগমন করেন, তিনি কে ছিলেন, তিনি কী ছিলেন না এবং কীভাবে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পরিসমাপ্তি ঘটে এসব বিষয়ে কুরআনে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

 

ঈসা(আঃ)কে নবী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া

 

ঈসা (আঃ) যে তাদের মধ্যে একজন এ নিয়ে কোন বিরোধ বা বিতর্কের অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেন : বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং ইবরাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যা মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রদান করা হয়েছে, তাতে ঈমান এনেছি। আমরা তাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী। (সূরা আল-ইমরান-৮৪)

 

 

 

কুরআনের একেবারে গোড়ার দিকেই ঈসা (আঃ) সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে : এবং নিশ্চয় মুসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, র্মাইয়াম-পুত্র ঈসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছি এবং পবিত্র আত্মা (হযরত জিবরাইল (আঃ) কে বুঝানো হয়েছে) দ্বারা তাকে শক্তিশালী করেছি। (সূরা বাকারাহ-৮৭)

 

ঈসা (আঃ) এর সময়কারের ঘটনা থেকে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, সেই সময় ইয়াহূদীদের দুটি দল ছিল যার একটি দল তার বিরোধী ছিল এবং আরেকটি দল তাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং ঈশ্বরপুত্র বলে দাবী করে।

 

মারিয়াম(আঃ) এর জন্মগ্রহণ

 

ঈসা(আঃ) এর নানা ইমরান(আঃ) একজন ধার্মিক লোক ছিলেন এবং তিনি দাউদ(আঃ) এর বংশধর ছিলেন।আল্লাহ তার পরিবারবর্গকে শয়তানের ধোঁকা থেকে পবিত্র করেছিলেন। তার স্ত্রী হান্না বিনতে ফায়াকূন একদিন দেখলেন একটি মা পাখি তার বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে তখন তিনি আল্লাহর কাছে একজন সন্তান প্রার্থনার জন্য দুআ করলেন।কারণ তিনি ছিলেন বন্ধ্যা।

 

তার ঘটনা কুরআনে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে,

 

: স্মরণ কর, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক ! আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত তোমার জন্য আমি উৎসর্গ করলাম। সুতরাং তুমি আমার কাছ থেকে তা কবুল কর, তুমি সর্ব শ্রোতা, সর্বজ্ঞ। তারপর যখন সে তাকে প্রসব করল, তখন সে বলল, হে আল্লাহ আমার প্রতিপালক! আমি কন্যা প্রসব করেছি। সে যা প্রসব করেছে আল্লাহ তা সম্যক অবগত। ছেলে তো মেয়ের মত নয়, আমি তার নাম র্মায়াম রেখেছি। এবং অভিশপ্ত শয়তান হতে তার ও তার বংশধরদের জন্য তোমার স্মরণ গ্রহণ করছি। তারপর তার প্রতিপালক তাকে সাগ্রহে কবুল করলেন এবং তাকে উত্তমরূপে লালন পালন করলেন এবং তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। যখনই যাকারিয়া কক্ষে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যেত তখনি তার কাছে খাদ্য-সামগ্রী দেখতে পেত। সে বলত হে র্মায়াম! এসব তুমি কোথায় পেলে ? সে বলত-আল্লাহর কাছ থেকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান করেন। সেখানেই যাকারিয়া তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করে বলল- হে আমার প্রতিপালক ! আমাকে তুমি তোমার কাছ থেকে সৎ বংশধর দান কর।  (সূরা আল-ইমরান-৩৫-৩৮)

 

সেই সময়ে তিনি একজন পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন।কারণ তার ইচ্ছা ছিল তার সন্তান বায়তুল মুকাদ্দাসের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব পালন করবে। একটি মেয়ে তার মাসিক সমস্যার জন্য দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না বলে, তিনি পুত্র সন্তানের কামনা করেন। কিন্তু তার গর্ভে একটি কণ্যা সন্তান তথা মারিয়াম(আঃ) এর জন্ম হল।ইমরান এবং হান্না আল্লাহর কাছে অভিযোগ করলে তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেন যে , এর ভিতর কল্যাণ রয়েছে।তার জন্মের ৭ম দিনে তার পিতা-মাতা কণ্যা সন্তানের এই নাম প্রদান করেন।

 

মারিয়াম(আঃ) এর মর্যাদা

 

মারিয়াম (আঃ) একজন সম্মানিত মহিলা।এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) চারজন নারীকে শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে ভূষিত করেছেন যারা হলেন হযরত খাদীজা(রাঃ), ফাতিমা(রাঃ), আয়শা(রাঃ) এবং মারিয়াম(আঃ)।

 

মারিয়াম(আঃ) এর জন্মের সময় আল্লাহ তার প্রতি এক বিশেষ করুণা প্রদর্শন করেছেন।তাকে শয়তান কোন ধরনের আছর করতে পারে নাই। বুখারী শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, শয়তান কেবলা মারিয়াম(আঃ) এবং ঈসা(আঃ) এর জন্মের সময় তাদের কোন ধরনের আছর করতে পারে নাই বলে তারা জন্মের সময় কান্নাকাটি করে নাই।

 

মারিয়াম(আঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

 

এছাড়া মারিয়াম(আঃ) কে যেন শয়তানের কু-মন্ত্রনা থেকে রক্ষা করা হয় এজন্য তিনি দুআ করেছিলেন এবং আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন।এবং তাকে দিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষণা-বেক্ষণ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি তার ভগ্নী-পতি যাকারিয়া(আঃ) এর উপর দায়িত্ব অর্পন করেন বায়তুল মুকাদ্দাসে তাকে দেখা-শোনা করার জন্য।কারন তার পিতা ইমরান মারিয়ামের জন্মের কিছুদিন পর মারা যান।

 

কিন্তু কিছুদিন পরে তিনি সেখান থেকে চলে যাম পূর্ব জেরুজালিমে।তিনি কি কারণে মুকাদ্দাস ছেড়ে তিনি সেখানে যান সেই ব্যপারে তিনটি মতামত পাওয়া যায় যা হলঃ

 

কেউ কেউ মনে করেন যে, সে নিজে পরিত্রান লাভের জন্য,কেউ বলেন, তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের নিয়ম-কানূনের জন্য এবং কেউ কেউ বলেন, তিনি একাকীত্বের সাথে ইবাদত করার জন্য তিনি সেখানে গমন করেছিলেন।

 

ঈসা(আঃ) এর জন্ম

 

তিনি যখন বায়তুল লাহাম অর্থাৎ, বেহেলহ্যাম এ গমন করেন তখন ঈসা(আঃ) এর জন্ম হয়। অতঃপর তার ঈসা(আঃ) এর জন্মবৃত্তান্ত নিম্নে পেশ করা হলঃ

 

ঈসা (আঃ) যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, কুরআনের একটি আয়াতে তার উল্লেখ করা হয়েছে : এবং আমি মারইয়াম পুত্র ও তার জননীকে করেছিলাম এক নিদর্শন, তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম এক নিরাপদ ও প্রস্রবণ বিশিষ্ট উঁচু ভূমিতে। (সূরা মুমিনুন-৫০)

 

তা সূরা ইমরানে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা সূরাহ মারিয়ামে বর্ণিত হয়েছে। সূরা মারইয়ামেও এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে : বর্ণনা কর, এই কিতাবে উল্লিখিত মারইয়ামের কথা, যখন সে তার পরিবার বর্গ থেকে পৃথক হয়ে নিভৃতে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল, তারপর তাদের কাছ থেকে সে পর্দা করল। এরপর আমি তার কাছে আমার রূহকে (জিবরাইল) পাঠালাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানুষ আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল।মারইয়াম বলল : তুমি যদি আল্লাহকে ভয় কর তবে আমি তোমার কাছ থেকে দয়াময়ের আশ্রয় গ্রহণ করছি।সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রতিপালক- প্রেরিত, আমি এসেছি তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য। [মারিয়ামঃ১৬-১৯]

 

এই সংবাদ শুনে মারিয়াম(আঃ) বিস্মিত হলেন এবং বলেন,

 

মারইয়াম বলল, কেমন করে আমার পুত্র হবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই।[মারিয়ামঃ২০]

 

তখন ফেরেশ্তা বললঃ

 

 সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এ জন্য সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্যে এক নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে এক অনুগ্রহ। এতো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।[মারিয়ামঃ২১]

 

মারিয়াম(আঃ) গাছ ঝাকাতে থাকলে খেজুর পাকা খেজুর পতিত হয় এবং সেখানকার পানি পান করে সে সুখে জীবন-যাপন করতে থাকে। তার সন্তানের সাথে।তিনি তার জ্ঞাতি ভাই ইউসুফের সাথে জেরুজালিম যেতে থাকেন।পথিমধ্যে বেথেলহ্যামের এক খেজুরের গাছের নীচে তার জন্ম হয় খৃষ্টপূর্ব ৩৩ অব্দে।।মারিয়াম(আঃ)কে তার গর্ভে ঈসা(আঃ)কে বেশীদিন গর্ভে ধারন করতে হয় নাই। ইবনে কাসীর বলেন, তিনি ঈসা(আঃ)কে নয় মাস গর্ভে ধারন করেছিলেন। যেখানে বলা হয়ছে,

 

তারপর সে তাকে গর্ভে ধরল, পরে তাকে গর্ভে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। প্রসব বেদনা তাকে এক খেজুর গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। [মারিয়ামঃ২২-২৩]

 

অতঃপর তিনি যখন সন্তান প্রসব করলেন ফেরেশ্তাগণ এসে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া শুরু করে এবং তা বলা হয়

 

 সে বলল, হায়, এর আগে যদি আমি মারা যেতাম আর যদি লোকের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতাম !তখন তার নীচের দিক থেকে ফেরেশতা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি দুঃখ কর না,তোমার পদতলে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন, তুমি খেজুর গাছের কাণ্ড তোমার দিকে নাড়া দাও, এর ফলে তোমার উপর পাকা খেজুর পতিত হবে। সুতরাং তুমি খাও, পান কর ও চক্ষু জুড়াও।   (সূরা মারইয়াম-২৪-২৬) এভাবে করে সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর তিনি আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে গমন করেন। যখন সে সন্তান নিয়ে গমন করেন তখন কিছু কুৎসা রটনাকারী তার বিরুদ্বে কুৎসা রটনা করতে থাকে। তখন আল্লাহ পাক তার যবানকে খুলে দেন এবং তিনি বলতে থাকেন,

 

হে   হারূণ-ভাগিনী, তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি   ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিনী। অতঃপর তিনি হাতে   সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা বললঃ যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে   কথা বলব?

 

 

 

আমি   যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময়   করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন নামায ও যাকাত আদায়   করতে।

 

 

 

এবং   জননীর অনুগত থাকতে এবং আমাকে তিনি উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি।

 

আমার   প্রতি সালাম যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করব এবং   যেদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উত্থিত হব। [মারিয়ামঃ২৯-৩৩]

 

 

 

ঈসা(আঃ) এর এই অলৌকিত্ব দেখে তারা তখন নিশ্চুপ হয়ে যায়।অতঃপর আল্লাহ তাদের লালন-পালন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

 

শৈশবকাল

 

ইয়াহূদীগণ বিশ্বাস করত যে, মসীহ নামে একজন নয়া নবীর আবির্ভাব ঘটবে যার দ্বারা তাদের রাজাকে হত্যা করা হবে।তাই তারা সতর্কতার জন্য বেথেলহেমে জন্ম গ্রহণ কৃত সকল শিশুকে হত্যা করার সিদ্বান্ত গ্রহণ করেছিল। তখন যাকারিয়া(আঃ) মারিয়াম(আঃ)কে নিয়ে ঈসা(আঃ) সহ মিসরে চলে যাওয়ার সিদ্বান্ত গ্রহণ করেছিল। অতঃপর তারা মিসরের গালিলির নাজেরাথে অবস্থান করেন।

 

সেখানকার রাজা হেরোদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন।১২ বছর বয়সে তাকে এক ধর্মীয় উপাসানালয়ে ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য প্রেরণ করা হয় এবং সেখানে বসে সে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে মুখস্ত করতে থাকে এবং অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখাতে থাকে। তার ১২ বছরের বয়সের সময় তিনি মিসরের এক গ্রাম প্রধানের চুরির ঘটনায় লিপ্ত এক অন্ধ ও খোড়া ব্যক্তিকে চোর হিসেবে সাব্যস্ত করতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন যা দেখে সকলে মুগ্ধ হয়ে যায়।

 

তার জীবনে এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে। তিনি বাহিরে বসে তার সাথীদের বলে দিতে পারতেন যে, কখন কার মা বাবা কি করছেন এবং কি কি আহার করতে পারছেন।কিন্তু কিছুদিনের ভিতর তার এই অলৌকিত্বকে সকলে অশুভ বলে মনে করতে লাগল তখন তার মাতা মারিয়াম(আঃ) তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

 

নবুয়াতী জীবন

 

এছাড়া কুরআনে ঈসার (আঃ) শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে কুরআনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।তিনি ১৮ বছর বয়সে নবুয়াত লাভ করেন।  তবে যারা তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন তারা তার আহ্বানে কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে : হে মুমিনগণ ! আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী হও। যেমন মারইয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল তার শিষ্যগণকে আল্লাহর পথে কে আমার সাহায্যকারী হবে ? শিষ্যগণ বলেছিল, আমরাই তো আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। এরপর বনী ইসরাইলদের একদল ঈমান আনল এবং একদল কুফরি করল। (সূরা সাফ্ফ-১৪)

 

দাওয়াতী কার্যক্রম

 

ঈসা (আঃ)-এর শিক্ষা যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন কিছু লোক তা গ্রহণ করল, কিছু লোক করল না : যখন মারইয়াম পুত্রের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয় তখন তোমার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল শুরু করে দেয় এবং বলে, আমাদের উপাস্যগুলো শ্রেষ্ঠ না ঈসা ? তারা কেবল বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই আমাকে একথা বলে। বস্তুত তারা তো এক বিতণ্ডাকারী সম্প্রদায়। সে তো ছিল আমারই এক বান্দা যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাইলের জন্যে দৃষ্টান্ত। (সূরা যুখরুফ-৫৭-৫৯) তিনি যে বাণী বহন করেছিলেন তা ছিল সহজ ও সরল : ঈসা যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ এল, সে বলেছিল, আমি তো তোমাদের নিকট এসেছি প্রজ্ঞাসহ এবং তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ, তা স্পষ্ট করে দেয়ার জন্যে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর। আল্লাহই তো আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক, অতএব তার ইবাদত কর, এটাই সরল পথ। (সূরা যুখরুফ-৬৩-৬৪)

 

তিনি প্রকৃতপক্ষে তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা,শরীয়াতের বিধানকে সহজীকরণ,অমূলক বিশ্বাসের ধারনা দূরীভূত,

 

তার মুজিযা

 

তাঁর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের কথা আবারও উল্লেখ করা হয়েছে : স্মরণ কর, আল্লাহ বললেন, হে মারইয়াম পুত্র ঈসা, তোমার প্রতি ও তোমার জননীর প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর : পবিত্র আত্মা দ্বারা আমি তোমাকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং তুমি দোলনায় থাকা অবস্থাও পরিণত বয়সে মানুষের সাথে কথা বলতে; তোমাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত ও ইনযিল শিক্ষা দিয়েছিলাম, তুমি কাদামাটি দিয়ে আমার অনুমতিক্রমে পাখি সদৃশ আকৃতি গঠন ও তাতে ফুঁ দিতে, ফলে আমার অনুমতিক্রমে নিরাময় ও আমার অনুমতিক্রমে মৃতকে জীবিত করতে; আমি তোমার ক্ষতি করা থেকে বনী ইসলাইলকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম; তুমি যখন তাদের মধ্যে স্পষ্ট নিদর্শন এনেছিলে তখন তাদের মধ্যে যারা কুফরি করেছিল, তারা বলেছিল-এতো স্পষ্ট যাদু। (সূরা মায়িদা-১১০)

 

 তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। ইমরানঃ৪৮

 

এসব আয়াতে এ গোলযোগপূর্ণ পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য স্মরণীয় একজন মানুষ হিসেবে ঈসা (আঃ)-এর আগমনের কথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে এমন একজন নবীর কথা যাকে প্রেরণ করা হয়েছিল তার সময় ও কালের জন্যে, আর তা মহা সত্যের উন্মোচনের অংশ হিসেবেই : মারইয়াম পুত্র ঈসাকে তার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে তাদের পশ্চাতে প্রেরণ করেছিলাম এবং মুত্তাকীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাকে ইনযিল দিয়েছিলাম, তাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো। (সূরা মায়িদা-৪৬) উপরন্তু সময় সম্পর্কেও কুরআনে বলা হয়েছে, যে বিষয়ে ঈসা (আঃ) নিজেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর আগে ও তাঁর পরেও সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল : স্মরণ কর, মারইয়াম পুত্র ঈসা বলেছিল : হে বনী ইসরাঈল ! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের কাছে যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা। (সূরা সাফ্ফ-৬) হাওয়ারীগণ তার সাথে সর্বদা থাকতেন।

 

অতঃপর ঈসা (আঃ) যখন বণী ইসরায়ীলের কুফরী সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারলেন, তখন বললেন, কারা আছে আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য করবে? সঙ্গী-সাথীরা বললো, আমরা রয়েছি আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। আর তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা হুকুম কবুল করে নিয়েছি।[ইমরানঃ৫২]

 

তাকে হত্যা করা

 

এভাবে করে তিনি দাওয়াত দিতে থাকলে যখন তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকট আসেন তখন তার জনপ্রিয়তাকে দেখে ইয়াহূদীগণ তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে।কিন্তু একদিন ইয়াহূদীদের ভিতর তাতাইনুস নামক এক ব্যক্তি যখন তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এখানে আসে তখন তার চেহারা ঈসা(আঃ) এর অনুরুপ হয়ে যায়। আর ঈসা(আঃ)কে আল্লাহ পাক আসমানে তুলে নিয়ে যান। আর অন্যদিকে যার চেহারা ঈসা(আঃ) এর চেহারার সাদৃশ্য হয় তাকে ক্রশবিদ্ব করে হত্যা করা হয়।যদিও খৃষ্টানগণ মনে করে যে, ঈসা(আঃ)কেই ক্রুশবিদ্ব করা হয়েছিল। কিন্তু আল-কুরআন তা খণ্ডন করেছে। আল-কুরআন ঈসা (আঃ)-এর ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যার দাবি প্রত্যাখ্যান করে, পক্ষান্তরে সমর্থন করে তাঁর ঊর্ধ্বারোহণকে ঃ আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি তাদের এ উক্তির জন্য তারা লানতগ্রস্ত। অথচ তারা তাকে হত্যাও করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, কিন্তু তাদের এ রকম বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমান করা ছাড়া তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করেনি।বরং আল্লাহ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী; প্রজ্ঞাময়। (সূরা আন-নিসা-১৫৭-১৫৮)

 

কাফিরদের চক্রান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ উত্তম কৌশল অবলম্বণ করলেন যার ফলে ঈসা(আঃ)কে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়।আল্লাহ বলেন,

 

এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী। [ইমরানঃ৫৪]

 

 

 

আল-কুরআন ত্রিত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে ঃ

 

এবং খৃষ্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র। এগুলো তাদের মুখের কথা। আগে যারা কুফরি করেছিল তারা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। (সূরা তাওবা-৩০) হে কিতাবিগণ! দ্বীনের ব্যাপারে বাড়বাড়ি কর না ও আল্লাহর সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বল না। মারইয়াম পুত্র ঈসা মসীহ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী যা তিনি মারইয়ামের কাছে প্রেরণ করেছিলেন ও তার আদেশ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তিন বলো না নিবৃত্ত হও, এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে। আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ। তাঁর সন্তান হবে, তিনি এ থেকে পবিত্র। আসমানে যা কিছু আছে ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই। কর্ম-বিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।মসীহ আল্লাহর বান্দা হওয়াকে হেয় জ্ঞান করে না এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও নয়; (সূরা আন-নিসা-১৭১-১৭৩)

 

 

 

আল্লাহ অন্যত্র ইরশাদ করেন,

 

তারা বলে,   আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র,   বরং নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন। [বাকারাঃ১১৬]

 

 

 

আল্লাহ সুরা ইখলাসে ঘোষনা করে দিয়েছেন, বলুন তিনি আল্লাহ এক। তিনি কারও মুখাপেক্ষী নন।তিনি কাউকে জন্ম দেন নাই এবং কেউ তাকে জন্ম দেয় নাই। তার কোন সমতুল্য নেই।

 

অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন ঈসা(আঃ) একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নন।,তাই তিনি ইরশাদ করেন,

 

মরিয়ম-তনয় মসীহ রসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে অনেক রসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন আর তার জননী একজন ওলী। তাঁরা উভয়েই খাদ্য ভক্ষণ করতেন। দেখুন, আমি তাদের জন্যে কিরূপ যুক্তি-প্রমাণ বর্ননা করি, আবার দেখুন, তারা উল্টা কোন দিকে যাচেছ।  [মায়িদাঃ৭৪]

 

উপসংহার

 

পরিশেষে বলা যায় যে, ঈসা(আঃ)কে আল্লাহ পাক অনেক হিকমত ও প্রজ্ঞা দান করেছিএলন।তার জীবনী থেকে এই বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, নিঃসন্দেহে তিনি একজন মহাপুরুষ তার জীবনাদর্শনের অনুসরণের মধ্য রয়েছে প্রকৃত মুক্তি।

No comments:

Post a Comment

৩৮ তম বিসিএস এর রেজাল্ট

৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এ কথা নিশ্চিত করেন। ...