মুরসাল হাদীস
মুরসাল
শব্দটি ইরসাল থেকে উদ্ভূত যার অর্থ হল খুলে দেওয়া, ছেড়ে দেওয়া, মুক্ত করা এবং
মুরসালের অর্থ হয় এই যে, মুক্ত,খোলা,পরিত্যক্ত,পরিত্যাজ্য ইত্যাদি।
উসূলে
হাদীসের পরিভাষায় মুরসাল বলা হয় ঐ সকল হাদীসসমূহকে যার সনদের শেষের দিকে তাবিঈ এর
পরবর্তী পর্যায়ের সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে। এরুপ করাকে ইরসাল বলা হয়। যেমন কোন তাবিঈ
তার শায়খের নাম উল্লেখ না করে বলেন, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এমনটি করেছেন।
ব্যাপক
অর্থে মুরসালের শাব্দিক অর্থ ও উসূলুল ফিকহীবিদগণের সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে আমরা
হাদীসে মুরসাল্কে ব্যাপক অর্থ ব্যবহার করতে পারি। আর তা সনদ থেকে বাদ পড়াকে ইরসাল
এবং এই হাদীসকে মুরসাল হাদীস বলা হয়।
আল্লামা
হাফিয বিন আসকালানী(রঃ) বলেন,
সনদের
শেষ বর্ণনাকারী যদি বাদ পড়ে যায়, তথা তাবিঈর নাম যদি সনদ থেকে বাদ পড়ে তাহলে ঐ
হাদীসটি মুরসাল হিসেবে গণ্য করা হবে।
মুফতী
আমিমুল ইহসান বলেন
সনদের
মধ্যে তাবিঈর পর বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়লে তাকে মুরসাল বলে।
ইমাম
নববী বলেন
ঐ
হাদীস হল মুরসাল যা কোণ তাবিঈ,সাহাবীর মাধ্যম ছাড়া সরাসরি রাসূল পর্যন্ত সংবাদ
দিয়েছেন।
উদাহরণ
ইমাম
মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায় একটি হাদীস উদ্বৃত
করেছেন,তিনি বলেন,
আমাকে
হাদীস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মদ ইবন রাবী,তিনি বলেন, আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা
করেছেন হুজাইন,তিনি লাইস, তিনি আকীল থেকে,তিনি ইবন শিহাব থেকে, তিনি সাঈদ ইবন
মুসাইবি থেকে রিওয়ায়াত করে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আমাদের মুযবানা পদ্বতিতে
ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।
এই
হাদীসে সাঈদ ইবন মুসাইবি একজন প্রবীণ তাবিঈ।তিনি এখানে সাহাবীর নাম উল্লেখ না করে
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।এটি একটি মুরসাল হাদীস।
এই
ধরনের হাদীস পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে যা হলঃ
১।
সাহাবা কর্তৃক ইরসাল
২।
তাবিঈ কর্তৃক ইরসাল
৩।
তাবী-তাবিঈ কর্তৃক ইরসাল
৪।
তাবী-তাবিঈ পরবর্তী যুগ কর্তৃক ইরসাল
৫।
সনদের ভিন্নতা
এখানে
সকল প্রাকারের মুরসাল হাদীসের বর্ণনা নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
১।
সাহাবা কর্তৃক ইরসাল
এটি
এই ধরনের ইরসাল যেখানে এক সাহাবা অন্য কোন সাহাবাদের থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছে।
আর তারা হাদীসটিকে এমনভাবে বলেছে যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এরুপ বলেছেন অথবা
এরুপ বলতে শুনেছি কিন্তু যেই সাহাবার কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন তার নাম উল্লেখ করেন
নাই।যেমন আবূ হুরায়রা(রাঃ) হিজরীর ৬ষ্ঠ-৭ম সনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু
তিনি তার আগে হিজরতের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
হুকুম
উক্ত
হাদীস সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য। কারণ শায়খ সাহাবী রাসূলুল্লহ(সাঃ) থেকে হাদীসটি
শুনেছেন আর তাদেরকে সর্বোত্তম বলা হয়েছে।
২।তাবিঈ
কর্তৃক ইরসাল
এই
হাদীস বর্ণনা করার সময় কোন তাবিঈ সাহাবীর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছেন। এর কারণ
হল এই যে, হাদীসটি এতটা প্রসিদ্বি লাভ করেছে এবং সেই সাহাবী এতটা জনপ্রিয় যে, তাই
সাহাবার নাম আর উল্লেখ করতে প্রয়োজন হয় নাই। সেই তাবিঈ এই কথা এভাবে বলেছেন যে,
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
এরুপ বলেছেন অথবা এরুপ বলতে শুনেছি।
হুকুম
এই
ধরনের মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে কারণ তাবিঈগণ আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের নিকট
অধিক মর্যাদাবান।
৩।
তাবি-তাবিঈ কর্তৃক ইরসাল
এখানে
হাদীসটি সুপরিচিতি হওয়ার ফলে সাহাবী তাবিঈ এর নাম উল্লেখ করেন নাই।
হুকুম
এই
ধরনের ইরসালের ব্যাপারে জুমহুর উলামাগণ নীরবতা অবলম্বণ করেছেন।তবে যদি এটা জানা
যায় যে, কোন নির্ভরযোগ্য রাবী থেকে তা বর্ণনা করেছে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে
অন্যথায় তা হবে না।
ইমাম
আবূ হানীফা এবং ইমাম মালিকের মতে তা গ্রহণযোগ্য হবে।কেননা রাবী তার শায়খের
ব্যাপারে অধিক হারে বিশ্বস্ত হওয়াতে তিনি আর তার নাম উল্লেখ করেন নাই।
অন্যদিকে
ইমাম শাফিঈ(রঃ) এর মতে, সাধারণভাবে তা গ্রহণযোগ্য নয়।কারণ এখানে রাবীর গুণাগুণের
ব্যাপারে কিছুই জানা যায় না।যদি তা জানা যায় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়।
৪।
তাবী-তাবিঈ পরবর্তী যুগ কর্তৃক ইরসাল
যদি
এই ইরসাল তা তাবি বা তাবিঈ পরবর্তী যুগে কেউ করে থাকে। তারা হাদীসটিকে এভাবে বলবে
, রাসূলুয়ল্লাহ(সাঃ) এরুপ বলেছেন অথবা এরুপ বলতে শুনেছি।
হুকুম
এই
হাদীসের বিশুদ্বতা নিয়ে ইমামদের ভিতর মতবিরোধ দেখা দেয়। কারও মতে তা গ্রহণযোগ্য
আবার কারও মতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেমনঃ ইমাম আবুল হাসান কারখী(রঃ) বলেন,
বর্ণনাকারীর ইরসালের দ্বারা এটি প্রতীয়মান হয় যে, তিনি হাদীসটির সনদের বিশুদ্বতা
সম্পর্কে নিশ্চিত।
ইমাম
ঈসা ইবন আবান এবং চার মাযহাবের মতে তা গ্রহণযোগ্য নয়।কারণ মুহাম্মদ(সাঃ) এর ৩
প্রজন্মের যুগের পর থেকে পাপাচারের যুগ শুরু হয়।তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়।
৫।
সনদের ভিন্নতা
যে
হাদীসে এক সনদে মুরসাল আর অন্য সনদে তা মুসনাদ এমন হতে পারে।
যেমনঃরাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
মেয়ের
সম্মতি ছাড়া বিবাহ হয় না।
হুকুম
এই
হাদীসের হুকুম হল তা গ্রহণযোগ্য হবে।চার মাযহাবের ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন। কিন্তু
কোন কোন মুহাদ্দিসের মতে তা গ্রহণযোগ্য হয়।
মুরসাল ও মুনকাতির মধ্যকার পার্থক্য
মুনকাতি
অর্থ হল কর্তন করা,কেটে ফেলা ইত্যাদি। অর্থাৎ, সনদের ধারাবাহিতায় যেকোন স্তরে কোন
রাবীর নাম বাদ পড়াকে মুনকাতি বলা হয়। আর মুরসাল হল ঐ ধরনের হাদীস যেখানে বর্ণনার
ধারাবাহিকতায় বর্ণনাকারীর নাম একদম শেষের দিকে বাদ পড়ে যায়। তা সাহাবীদের
নামের সাথে বাদ পড়তে পারে।অন্যদিকে ইনকিতা হাদীস মুনকাতি সাক্ষ্যহীনতার কারণে বা
হাদীসের রিওয়য়াত না থাকার ফলে তা হতে পারে।
এখানে
মুনকাতি এবং মুরসালের সম্পর্ক আম-খাসের ন্যায়। মুনকাতি হল আম আর মুরসাল হল খাস।
সকল মুনকাতি মুরসাল কিন্তু সকল মুরসাল মুওকাতি নয় যেমনিভাবে সকল রাসূল নবী হন
কিন্তু সকল নবী রাসূল নন তেমনিভাবে সকল রাসূল নবী কিংবা সকল মানুষ প্রাণী হলেও সকল
প্রাণী মানুষ নয়।
No comments:
Post a Comment