ভূমিকা
যেখানে সকল ধর্মসমূহের মূল লক্ষ্য
থাকে,
স্বর্গ লাভ করা সেখানে বৌদ্ব ধর্মের মূল লক্ষ্য হল নির্বাণ
লাভ করা। বৌদ্বধর্মে নির্বাণের বিষয়টি খুব একটা সুস্পষ্ট নয়। মহামতি গৌতম বুদ্ব
বিভিন্ন ধরনের আলোচনার মাধ্যমে নির্বাণ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারনা প্রদান
করেছিলেন। বৌদ্বধর্মে চারটি আর্যসত্য আছে যা হল দুঃখ আছে।দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ থেকে মুক্তি আছে এবং দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় আছে। আর
এই দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় হল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। যা হল সম্যক জ্ঞান, সম্যক সংকল্প,সম্যক বাক্য, সম্যক জীবিকা, সম্যক প্রচেষ্টা,সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি।এগুলোকে অনুশীলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত মুক্তি বাঃ
নির্বাণ লাভ করা সম্ভব হয়। নির্বাণের অন্য অর্থ হল লোভ,দ্বেষ,মোহ বা তৃষ্ণাকে
সমূলে ধ্বংস করা সেই সাথে জন্ম,মৃত্যু, প্রিয়,বিয়োগ, পঞ্চান্দ্রীয়া থেকে সকল প্রকার দুঃখ ঘোচন করে চিরমুক্তি লাভ
করে যে বিমুক্ত লাভ করে তাই নির্বাণ।
নির্বাণের ধারনা
নির্বাণ কি তা নিয়ে বৌদ্ব
পণ্ডিতদের ভিতর বিভিন্ন ধরনের মতামত পাওয়া যায়।
কারও মতে,এটি হল কর্ম বা জন্মের অনন্ত ধারার পরিসমাপ্তি। এ হচ্ছে
একজন মানুষের অন্তিম প্রশান্তি। যাকে আর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না যার কামনা
বাসনা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। এটি হল মানুষের অন্তিম প্রশান্তি।
কারও মতে, নির্বাণ হল মানুষের বর্তমান জীবনের একটি অবস্থার নাম। তখন
আমাদের চারিত্রিক উন্নতি এতটার উন্নতি ঘটবে যে, আমাদের আর কোন আবেগ কিংবা আকাঙ্ক্ষা অবশিষ্ট থাকবে না। তাই নির্বাণকে পূর্ণ
বিলুপ্তি বলা যেতে পারে।
কিন্তু তারা পূর্ণ বিলুপ্তিকে
অস্বীকার করেছে। যেভাবে তারা মানবত্মার স্থায়ীত্বকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতে
একটি মধ্যবর্তী অবস্থা। তারা মনে করে থাকে যে, জীবন একটি অভিশাপ। মানুষকে এই অভিশাপ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।আর তারার মনে করে
যে জীবন একটি সফর মানুষের জন্য আর একদিন তা শেষ হয়ে আসবে।
আরেকদল পণ্ডিতদের মতে, এটি জীবনের চারিত্রিকস্বরুপ। এর দ্বারা তার চরিত্র পরিস্ফুট
হয়ে উঠে।
মহাকবি অশ্বঘোষ নির্বাণকে একটি প্রদীপের সাথে
তুলনা করেছেন। একটি প্রদীপ যেমন জ্বলতে জ্বলতে এক সময় নিভে যায় এবং শান্তি লাভ করে
তেমনিভাবে মানুষ নির্বাণ লাভের দ্বারা চূড়ান্ত শান্তি লাভ করে থাকে। পুনর্জন্মে
সাধন করে থাকে।
সকল দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটে
নির্বাণের দ্বারা। মানুষের নির্বাণ শেষ হলে মানুষের দুঃখেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।
নির্বাণ লাভের পর মানুষের কি
অবস্থা হয় তা নিয়ে চিন্তা করাকে অনর্থক বলে অভিহিত করা হয়েছে।একবার বুদ্বকে
জিজ্ঞাসা করা হল যে, নির্বাণ লাভ
করার পর কিছু থাকবে কি?তিনি উত্তরে
বললেন,
“না”। অতঃপর পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলঃ কিছু না থাকবে? তিনি বললেন, না। আবার জিজ্ঞাসা করা হল এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোন অবস্থানে কি থাকবে? আবার বললেন, না। জিজ্ঞাসা করা হল, এই দুই অবস্থার
বাইরে?
আবার তিনি বললেন না। অর্থাৎ, নির্বাণের পর কি মানুষ অনস্তিত্বে থাকবে নাকি অস্তিত্বে সেই ব্যাপারে তিনি
কিছুই বললেন না।
বুদ্বের জীবনের তিনটি মূল্যবোধের
প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে। যা হল বৈরাগ্য, মৈত্রী এবং প্রজ্ঞা। বুদ্বের জীবনের ভিতর সুস্পষ্টরুপে প্রতীয়মান হয়। এই তিনটি
গুণের দ্বারা নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়। তার মন্তে তিন ধরনের সমস্যা মানুষকে বারবার
দুঃখের দিকে নিয়ে যায় যা হল তৃষ্ণা, দ্বেষ ও অবিদ্যা। বৈরাগ্য হল তৃষ্ণার প্রতিষেধক, মৈত্রী হল দ্বেষের প্রতিষেধক এবং প্রজ্ঞা হল অবিদ্যার প্রতিষেধক।
নির্বাণ চারটি স্তরে লাভ করা হয়
যা হল
প্রথম ধাপে বিতর্ক ও বিবেক থাকে
দ্বীতিয় ধাপে বিতর্কের লোপ ঘটে।
৩য় ধাপে প্রীতির লোপ ঘটে আর কেবল
সুখ থাকে।
৪র্থত ধাপে সুখও লোপ হয়ে যায় তখন
শুধুমাত্র শরীরের সম্পর্ক ত্যাগ করতে চায়।
নির্বাণ ও ফানার মধ্যকার পার্থক্য
১। ফানার দ্বারা আত্মা আল্লাহর
অস্তিত্বে গমন করেন আর নির্বাণের দ্বারা আত্মা কোথায় চলে যায় তা কেউ জানে না।
২। ফানার দ্বারা সাধকগণ আল্লাহর
অস্তিত্বে বিলীন হয়ে পৃথিবীর ভিতর থাকেন আর নির্বাণলাভের পর কেউ এখানে থাকতে পারে
না।
৩। ফানায় স্রষ্টার সন্তুষ্টির
জন্য লিপ্ত হয় আর নির্বাণে নিজের মুক্তির জন্য লিপ্ত হয়।
৪। ফানার দ্বারা পার্থিব জীবনকে
ত্যাগ করার শিক্ষা দেয় না কিন্তু নির্বাণে সেই শিক্ষা দেয়।
৫। ফানায় আত্মা ও দেহ উভয়ের দর্শন
আছে কিন্তু নির্বাণে তা নেই।
৬। ফানা সদর্থক আর নির্বাণ
নির্থক।
৭। ফানা সূফী-সাধকদের শেষ স্তর নয়
কিন্তু নির্বাণ বৌদ্বদের জন্য সর্বশেষ স্তর।
৮। ফানার দ্বারা সূফীগণ বাকার
স্তরের গমন করেন অন্যদিকে নির্বাণের দ্বারা মানুষ চূড়ান্ত মুক্তি লাভ করে।
৯। ফানা নৈতিক ও তাত্ত্বিক, অন্যদিকে নির্বাণ তাত্ত্বিক।
১০। ফানার দ্বারা আত্মিক
প্রশান্তি ঘটে আর নির্বাণের দ্বারা দুঃখের মুক্তি ঘটে।
১১। ফানাফিল্লাহের দ্বারা আল্লাহর
অস্তিত্ব লাভ হয় কিন্তু নির্বাণের তা দ্বারা হয় না।
১২। ফানা পার্থিব জীবনের প্রতি
গুরুত্বারোপ করে থাকে কিন্তু নির্বাণ তা দেয়া না।
১৩। ফানা আত্মাকে শান্তি দেয় আর
নির্বাণ আত্মাকে দমন করে।
১৪।জান্নাত লাভ হল ফানার মুখ্য
উদ্দেশ্য আর নির্বাণের মুখ্য উদ্দেশ্য হল দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ
১৫। ফানার দলীল হল কুরান-হাদীস আর
নির্বাণের দলীল হল গৌতম বুদ্ব।
১৬। ফানা সর্বজনীন নয় আর নির্বাণ
সর্বজনীন।
১৭। ফানার দ্বারা নমোস্তর হয় আর
নির্বাণের দ্বারা সকল সম্ভাবনার বিলুপ্তি ঘটে।
১৮। ফানার দ্বারা তাওহীদ
প্রতিষ্ঠিত হয় আর নির্বাণের দ্বারা দুঃখ হতে মুক্তি লাভ কয়া যায় কেবল।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, ফানা এবং নির্বাণ দুটি ভিন্ন বস্তু। যা দুটি পৃথক পৃথক
ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে এই উভয় অবস্থায় দ্বারা নিজেদের পৌছাতে পারবে তারাই
প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে।
No comments:
Post a Comment