ভূমিকা
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
বলেন,
আমার
উম্মাতের ভিতর মতপার্থক্য রহমতস্বরুপ।
আলোচ্য
হাদীসের দ্বারা রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এ কথাটি সকলের কাছে বুঝাতে চেয়েছেন যে, শরয়ী
বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা দোষের কোন কিছু নয়।তা থাকা স্বাভাবিক এবং সেই ব্যাপারে
মতপার্থক্য উম্মাতের জন্য অভিশাপ নয় বরং, তা রহমতস্বরুপ। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর যুগে
সাহাবাদের ভিতর কোন রকমের মতপার্থক্য ছিল না।তাদের মনে কোন প্রশ্ন জাগলে তারা
সরাসরি আল্লাহর রাসূলের কাছে থেকে জেনে নিতেন।তাই তাদের মধ্যকার কোন ধরনের
মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় নাই। কিন্তু পর্যায়ক্রমে রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর ওফাতের পর
থেকে সাহাবাদের ভিতর মতপার্থক্য হওয়া শুরু হয়। তা বিভিন্ন কারণে হতে থাকে। এর
ফলশ্রুতিতে তা তাবিঈ তাবিঈ এমন কি ফকীহদের পর্যন্ত তা বিরাজমান ছিল এবং সেই ধারা
আজ অবধি বিরাজমান আছে এবং তা কিয়ামত অবধি থাকবে। মুহাম্মদ(সাঃ) এর পর থেকে ফকীহদের
ভিতর যেই সকল মতভেদসমূহ লক্ষ্য করা যায় তার কারণসমূহ নিম্নে পর্যায়ক্রমে আলোচনা
করা হলঃ
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
এর ওফাতের পর থেকে মতভেদকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায় যার একটি হল সাহাবাদের যুগে
মতপার্থক্য এবং অপরটি হল সাহাবা পরবর্তী যুগে ফকীহগণের ভিতর মতপার্থক্য। এই দুই
ধরনের মতপার্থক্য নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
সাহাবাদের যুগে মতপার্থক্য
নবী
করিম(সাঃ) এর ওফাতের পরে সাহাবাদের ভিতর সর্বপ্রথম মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় যার পিছনে
বেশ কয়েকটি কারণ ছিল।শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী(রঃ) এর পিছনে মোট সাতটি কারণ তিনি
দাড় করান যা হল নিম্নরুপঃ
১.
রাসূলের হাদীস না জানার কারণ
সাহাবাগণ
আল্লাহর রাসূলের অত্যন্ত কাছে থাকার জন্য চেষ্টা করতেন এবং থাকতেন। কিন্তু তাদের
ভিতর অনেকে সাহাবী ছিলেন যারা ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিকভাবে আল্লাহর রাসূলের কাছে
থাকতে পারতেন না। হয়তো রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কখনও কখনও এমন কাজ করেছেন বা এমন কথা
বলেছেন যা কোন সাহাবা কখনও প্রত্যক্ষ করে নাই। যার ফলে সাহাবাদের ভিতর তখন এক
ধরনের মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়।কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হলঃ
ক. কোন সময়ে এমন অবস্থা হত যে, সাহাবা কোন
সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট মাসালা কিংবা হাদীস জানতেন না।তখন তারা
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর ন্যায় ইজতিহাদ করতেন। একবার এক মহিলার ব্যাপারে ইবন
মাসউদ(রাঃ)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, এক মহিলার মুহর নির্ধারণের আগে এবং তার সান্নিধ্যতা
লাভের তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে? তখন ইবন মাসউদ(রাঃ) তাকে বললেন এই
ব্যাপারে তার রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কি বলেছেন তা তার জানা নাই। তখন লোকটি তা জানার
ব্যাপারে রাসূলের কাছে পীড়াপীড়ী করলে ইবন মাসউদ(রাঃ) এই ফাতওয়া দিলেন যে, মহিলাটি
যদি পূর্ণ ইদ্দত করে তাহলে সে মুহরের টাকাও পাবে তার সমমর্যাদার অধিকারী মহিলার
ন্যায় আবার সেই সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তিও পাবে তবে শর্ত হচ্ছে তাকে পূর্ণ
ইদ্দত করতে হবে। তখন তার এই ইজতিহাদের কথা শুনে মাকাল ইবন ইয়াসার(রাঃ) বলেন,
আল্লাহর রাসূলও অনুরুপ ফয়সালা করেছিলেন।
খ.
কখনো তারা নিজেরা
ইজতিহাদ করতেন আর যদি হাদীস জানতে পারতেন তাহলে তারা তখন সেই ইজতিহাদ ত্যাগ করে
হাদীসের উপর আমল করতেন।যেমনঃ আবূ হুরায়রা(রাঃ) মনে করতেন যে, কেউ যদি সূর্যোদয়ের
আগে ফরয গোসল যদি না করে (যদি গোসল ফরয হয়) তাহলে তার রোযা হয় না। তিনি যখন জানতে
পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর পবিত্র স্ত্রীগণ এর বিপরীত আমল করতেন তখন তিনি তা
পরিহার করেন।
গ.
কখনও কোন একটি হাদীস
সাহাবাদের কাছে পৌছলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সাহাবাদের প্রশ্ন থাকত যার ফলে তারা
তা গ্রহণ করত না।যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবন উমর(রাঃ) মনে করতেন যে, গোসল ফরয হওয়ার পর
যদি কেউ তায়াম্মুম করে তাহলে তার ফরজ আদায় হবে না।কিন্তু এর বিপরীতে আম্মার ইবন
ইয়াসার(রাঃ) একটি হাদীস বর্ণনা করেন যেখানে বলা হয় যে, এক সফরের সময়
তিনি এবং রাসূলুল্লাহ(সাঃ) একই সাথে ছিলেন। তখন গোসল করা জরুরি ছিল। কিন্তু পানি
না থাকার দরুন তারা সেই সময় গোসল না করে তায়াম্মুমের দ্বারা গোসলের কাজ সম্পন্ন
করেন।
ঘ.
কখনও এমন কোন ধরনের
হাদীস ছিল যা সাহাবাদের কাছে পৌছে নাই।যেমনঃ ইবন উমর(রাঃ) মহিলাদের গোসলের সময়
চুলের খোপা খুলে গোসল করতে বলতেন।কিন্তু আয়শা(রাঃ) যখন এর বিপরীতে একটি হাদীস
বর্ণনা করলে তখন তা তিনি প্রত্যাহার করে নেন।
২.রাসূলের
কাজের পার্থক্য নির্ণয়ঃ
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
কোন কাজ এমনভাবে করেছেন যা কোন কোন সাহাবা মুবাহ আবার কোন কোন সাহাবা ইবাদত মনে
করেছেন।যেমনঃরাসূলুল্লাহ(সাঃ) হাজ্জের সময় তিনি আবতাহ উপত্যকায় অবতরণ করেন। এটাকে
আবূ হুরায়রা(রাঃ) এবং ইবন উমার(রাঃ) এর দৃষ্টিতে ছিল একটি ইবাদত।কিন্তু আব্দুল্লাহ
ইবন আব্বাস(রাঃ) এবং আয়শা(রাঃ) এই মতামত প্রদান করেছিলেন যে, এটা একটি নিছক সাধারণ
ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এরকম
আরেকটি দৃষ্টান্ত ছিল এমন যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কাবা তাওয়াফের সময় রমল করতেন।তা
মুশরিকদের ভৎর্সনার জবাবে করা হত। কিন্তু তা কেবলমাত্র সমসাময়িক লোকদের জন্য করা
জায়েয ছিল সকলের জন্য নয়।
৩.
ধারনাগত পার্থক্য
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
তার কার্যসমূহ এমনভাবে সম্পাদন করেছে যে, সেই বিষয়ে ধারনাগত পার্থক্য পরিলক্ষিত
হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ(সাঃ) তার জীবদ্দশায় কেবলমাত্র একবার হাজ্জ সম্পন্ন
করেছিলেন।কিন্তু তিনি কোন ধরনের হাজ্জ করেছেন তা নিয়ে সাহাবাদের ভিতর মতপার্থক্য
লক্ষ্য করা যায়।যেমন কেউ বলেছেন তা হাজ্জে কিরান,আবার কেউ বলেছেন হাজ্জে তামাত্তু
আবার কেউ কেউ বলেছেন হাজ্জে ইফরাদ।
একজন
বর্ণনা করেছেম যে, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) ইহরাম বাধার পর তালাবিয়া পাঠ করেছেন।কিন্তু
পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রাঃ) বললেন যে, শুধুমাত্র ইহরাম বাধার পর নয় বরং
আরও বিভিন্ন ধরনের পরিবেশের কারণে তিনি এমন আমলটি করেছেন।
৪.
ভুলে যাওয়ার কারণে পার্থক্য
কখনও
ভুলসূচক কারণে সাহাবাদের ভিতর মতপার্থক্য দেখা দিত। যেমনঃ একবার ইবন উমার(রাঃ)
বললেন, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) রজব মাসে উমরা করেছেন। তখন তার এই কথা শুনে আয়শা(রাঃ)
বললেন, তিনি হয়তো ব্যাপারটা ভুলে গেছেন।
৫.
বক্তব্যের সঠিক উদ্দেশ্য আয়ত্ত না করার পার্থক্য
বক্তব্যের
সঠিক অনুধাবনে না করার জন্য অনেক সময় সাহাবাগণের ভিতর মতপার্থক্য দেখা যেত।যেমন
একবার এক মৃতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূল্লাহ(সাঃ) সকলের ক্রন্দনের শব্দ শুনতে
পেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, এরা এখানে সকলে কান্না-কাটি করছে আর তার আযাব
হচ্ছে।
ইবন
উমর (রাঃ) এর উক্তি হল এই যে, ক্রন্দনের জন্য কবরে আযাব হচ্ছে।কিন্তু আসল কথা হল
ক্রন্দনের জন্য নয় বরং সাধারণভাবে ঐ মাইয়াতের জন্য এই কথা বলা হয়েছে।
৬.
বিধানের কারণ নির্ণয়গত পার্থক্য
কোন
মৃত ব্যক্তির কফিন সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ(সাঃ) দাঁড়িয়ে যেতেন এবং
সকলকে সেই নির্দেশ প্রদান করতেন। কিন্তু তিনি কি কারণে তা করতেন তা সকলে নির্ণয়
করতে পারেন নাই।কারণ তা হয়তো ফেরেশ্তাদের সম্মানার্থের করা হত অথবা তা মৃত্যুর কথা
স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা তা মাথার উপর লাশ না থাকার জন্য তা করা হত। যদি
শেষোক্ত কারণে তা করা হয় তাহলে তা কেবল অমুসলিম মৃতার জন্য হতে হবে।
৭.সামঞ্জস্য
বিধানগত পার্থক্য
কোন
কোন ক্ষেত্রে বিধানের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য মতপার্থক্য দেখা দেয়। যেমনঃ খাইবারের
যুদ্বের সময় মুতআ বিবাহ জায়েয ছিল।কিন্তু পরবর্তীতে তা রহিত করা হয়। আবার আওতাস
যুদ্বের সময় সেই অনুমতি দেওয়া হয়।কিন্তু তা আবার পরে রহিত করা হয়। এর ব্যাখ্যায়
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রাঃ) বলেন, প্রয়োজনে মুতআ বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তা প্রয়োজন শেষ হওয়ার সাথে সাথে তা রহিত হয়ে যায়।
আবার
মুহাম্মদ(সাঃ) কিবলামুখী হয়ে এবং তার বিপরীতমুখী হয়ে ইস্তিঞ্জা করতে নিষেধ করেছেন।
কিন্তু তার ওফাতের ঠিক এক বছর পূর্বে রাসূলুল্লাহ(সাঃ)কে একবার কিবলার বিপরীতমুখী
হয়ে ইস্তিঞ্জা করতে দেখা গিয়েছে।
৮.
অঞ্চলভিত্তিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থ অনুন্নত থাকার কারণ
মুসলিম
সম্রাজ্য ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং বিভিন্ন স্থানে
স্থান,কাল,পাত্রভেদে মতপার্থক্য শুরু হয়।আর তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকার
দরুন এক এক জায়গার সাহাবী এক একভাবে ইজতিহাদ করেছে যার ফলে মতভেদ সেখানে সৃষ্টি
হয়।
ফকীহগণের মধ্যকার মতভেদ
১।
সাহাবাদের ভিতর মতভেদ
রাসূলুল্লাহ(সাঃ)
এর ওফাতের পর থেকে বিভন্ন ধরনের মাসালা-মাসায়েল নিয়ে তার সাহাবাদের ভিতর বিভিন্ন
ধরনের মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সামঞ্জস্য বিধানগত পার্থক্য, রাসূলের কাজের
পার্থক্য নির্ণয়, সাহাবাদের ধারনাগত পার্থক্য , সাহাবাদেরভুলে যাওয়ার কারণে
পার্থক্য , সাহাবাদের বক্তব্যের সঠিক উদ্দেশ্য আয়ত্ত না করার পার্থক্য , সাহাবাদের
বিধানের কারণ নির্ণয়গত পার্থক্য ,রাসূলের হাদীস না জানার কারণ ইত্যাদি কারণে
পববর্তীতে ফুকাহে-কেরামের ভিতর মাসালা নিয়ে আরও প্রকট আকারে ধারন করে।
২।হাদীসের
গ্রহণযোগ্যতা না থাকার দরুন
কোন
কোন হাদীস কোন এক ইমামের দৃষ্টিতে তা সহীহ হলেও অন্যের কাছে তা দূর্বল আবার
তার কাছে যদি একটি শক্তিশালী মনে হয় তাহলে তা অন্যের কাছে দূর্বল বলে সাব্যস্ত হতে
পারে।
৩।
খবরে ওয়াহেদের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে মতভেদ
এক্ক
সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো গ্রহণের জন্য যেসকল শর্ত আরোপ করা হয় তার মাঝেও ইমামদের
মধ্যে মতবিরোধ আছে।কারও শর্ত অত্যন্ত নমনীয়।আবার কারও শর্ত অত্যন্ত কঠোর। যেমনঃ
ইমাম আবূ হানীফা সময়ে কূফার লোকেরা বিভিন্নভাবে হাদীস জাল করতে থাকে,তাই সেখানে
কঠোর শর্তারোপ করা হয়।আবার কেউ কেউ এরকম শর্তারোপ করতেন যে, হাদীস কুরআনের সাথে
সংঘর্ষমূলক না হলেই হবে। আবার কেউ শর্ত দিয়েছে, হাদীসের রাবী ফুকাহা কিনা।যদি তাই
হন তাহলে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য হবে অন্যথায় হবে না।
৪।হাদীস
বিস্মৃত হয়ে যাওয়া
কোন
কোন সময়ে কোন মুজতাহিদের মাসালা জানা থাকলে তার হাদীসের স্মৃতিপট থেকে হাদীস বিস্মৃতি
হয়ে যায়। এই সময় সে হাদীসের নির্দেশ না পেয়ে অন্যান্য যুক্তির উপর ভিত্তি করে
মাসালা প্রদান করেন। এটি অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে তিনি অপরাগ এবং ক্ষমার যোগ্য।
হযরত উমার(রাঃ) এর খিলাফতকালে একবার তিনি ফরয গোসলের ব্যাপারে একটি মাসালার হাদীস
জানা সত্ত্বেও তিনি তার সমাধান এভাবে করে কিয়াসের আলোকে প্রদান করতেন।
৫।
অর্থের নির্ণয়ে মতভেদ
অনেক
সময়ে একটি হাদীসের অর্থ নির্ণয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় যা নিতে মতভেদ সৃষ্টি হয়। যেমনঃ
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, খামর পান করা নিষিদ্ব। এর অর্থ দাড়ায় আঙ্গুরের রস।কিন্তু
কেবল আঙ্গুরের রস খাওয়া হারাম নয়।বরং,যা আমাদের মস্তিস্কের বিকৃতি ঘটায় তাই হল
খামর।তাই রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন,
মস্তিস্কের
বিকৃতিকারী যাওবতীয় বস্তু খামর আর যাবতীয় নেশাজাতীয় বস্তু হারাম।
তাই
বুঝা গেল যে, শুধুমাত্র একই শব্দের বহুতমূলক অর্থ থাকের যার ফলে তার উপর আমল করার
পিছিনে ফকীহগণের মতভেদ সৃষ্টি হয়।
৬।
কিরাত্বের ব্যাপারে মতভেদ
পবিত্র
কুরআনের আয়াতের ভিতর অসংখ্য শব্দাবলী রয়েছে যাদের ভিতর ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।
যেমন আল্লাহ বলেন,
আর
টাখনু পর্যন্ত পা ধৌবে [মায়িদাঃ৬]
এখানে
জুলাকুম লাম এর উপর যবর থাকাতে তার দ্বারা মুখ ও হাতের কথা বলা হয়েছে। আবার যদি
তার উপর যের থাকে তাহলে এর দ্বারা জলিকুম বুঝানো হয় যার দ্বারা মাথা মসেহের কথা
বলা হয়েছে। ধৌত করা আবশ্যক নয়।এরকম করে একই শব্দের বিভিন্ন কিরাআতের জন্য ফকীহগণের
ভিতর মাসালাগত পার্থক্য সৃষ্টি হয়।
৭।ইজতিহাদের
জন্য
মুহাম্মদ(সাঃ)
এর ওফাতের পর থেকে সাহাবাগণের ভিতর ইজতিহাদের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ
পরলক্ষিত হয়। তারা নিজেদের বুদ্বিমত্তাকে প্রয়োগ করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান
করতেন তখন মতবিরোধ চারিদিকে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
৮।
কুরআন হাদীসে সঠিক সমাধান না থকার দরুন
কুরআন-হাদীসে
কোন কোন ক্ষেত্রে কোন বিষয়ের সরাসরি সমাধান না থাকলে পরবর্তীতে তা যখন সেই বিষয়ে
নিয়ে যখন তারা আলোচনা করে তখন মুজতাহিদ্গণ তাদের চিন্তা-ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন
ধরনের মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। যেমনঃএকবার উমর(রাঃ) এর খিলাফতকালে ইয়ামানে এক
মহিলা তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে পরকীয়ায় নিমজ্জিত হয়।আর তখন তার সেই প্রেমিক,সে
এবং তার এক দাস মিলে তার স্বীয় পুত্রকে হত্যা করে।এখন এর ফয়সালা কি হবে তা
উমর(রাঃ) জানতে পারলে তিনি জানিয়ে দেন যে, সকল সানাবাসী যেন একসাথে তাদের হত্যা
করে।
কিন্তু
পরবর্তীতে ইবন যুবায়র,ইবন সীরিন, রবীয়াতুর রায়, দাউদ, ইবনুল মুনযির বলেন এখানে
রক্তপণ দিলেই হব।কারণ এই ধরনের সম্মিলিত হতায়কাণ্ড রাসূলের যমানায় ছিল না বলে তারা
এই ধরনের মতামত দেয়।
৯।হাদীস
সংগ্রহে না থাকা
কোন
কোন সময়ে তাদের কাছে হাদীসসমূহ সঠিকভাবে জানা ছিল না।যার ফলে তাদের মধ্যকার বিভিন্ন
ধরনের মতভেদ দেখা দেয়। যেমন আহমদ বিন হাম্বল(রঃ) কবরের পাশে কিরাত পাঠ করাকে
বিদাআত মনে করতেন।কিন্তু পরবর্তীতে যখন তার সামনে হাদীস বলা হয় তখন তিনি তার
বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেন।
১১.
ইত্তিসালে সনদের জন্য
এ
ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই যে, হাদীস বিশুদ্ব হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত লাগে। তা হল
ইত্তিসালে সনদ, আদালতে রাবী,যবতে রাবী, হাদীসের সনদ ও মতন এবং মারাত্মক ধরনের
ব্যতিক্রমতাধর্মিতা ও আপ্ততিদুষ্টতা থেকে মুক্ত থাকা। এই পাঁচটি শর্তের ব্যাপারে
কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু তার বিস্তারিত বিশ্লেষণে এর ভিতর মতভেদ দেখা দেয়। ইমাম
বুখারীর মতে রাবীদের ভিতর পরস্পর একবার সাক্ষাৎ হল হাদীস বিশুদ্ব হওয়ার একটি
শর্ত।কিন্তু ইমাম মুসলিমের মতে, এর জন্যে সাক্ষাৎ জরুরী নয়,বরং এর জন্যে
স্থান,কাল এক হলেই হয়।
মুরসাল হাদীস গ্রহণে
মুরসাল
হাদীস শরীয়াতের পরিভাষায় ঐ ধরনের হাদীস বলা হয় যার দ্বারা সাহাবীর নাম উল্লেখ না
করে তা সরাসরি তাবিঈ এর সাথে সংক্লিষ্ট।এই সকল হাদীস গ্রহণযোগ্য নাকি অগ্রহণযোগ্য
তা নিয়ে মুহাদ্দিসগণের ভিতর মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম মুসলিম,আহমদের মতে তা
গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা(রঃ),ইমাম বুখারী, ইমাম মালিক সহ অনেকে এই
মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, মুরসালের হাদীসের উপর আমল করা যায়। ইমাম শাফি(রাঃ)
শর্তসাপেক্ষে একে বৈধতা প্রদান করেছেন।
রাবীদের যোগ্যতা এবং স্মরণশক্তি
একটি
হাদীস বিশুদ্ব হওয়ার জন্য রাবীদের বিশ্বস্ত হওয়া উচিৎ।কিন্তু তাদের বিশ্বস্ততা কোন
পর্যায়ের হবে তা নিয়ে ইমামগণের মতভেদ আছে।কারও মতে, রাবীকে মুসলিম হলেই হবে,কেউ
বলেছেন তার সাথে বিশ্বস্ত হতে হবে,কারও মতে তাকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন দুই দিক
দিয়ে বিশ্বস্ত হতে হবে, আবার কারও মতে তাকে বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য দুই জনের সাক্ষ্য
লাগবে। তেমনিভাবে রাবীদের স্মরণশক্তি কেমন হবে সেটার ভিত্তিতে ফকীহগণের ভিতর
মতবিরোধ দেখা দেয়।
দূর্বল হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা
এখন
একটি হাদীস শক্তিশালী নাকি দূর্বল সেটির মাপকাঠির জন্য হাদিসটি ফকীহ দৃষ্টিতে কোন
পর্যায়ে পড়বে তা নিয়ে ইমামগণের মতভেদ রয়েছে। কারও মতে তা কোনভাবে তার উপর আমল করা
জায়েয নেই। তবে চার মাযহাবের ইমামের মতে, দূর্বল হাদীস যদি ফাযায়েলের সাথে
সম্পর্কিত হয় তাহলে তার উপর আমল করা জায়েয ও মুস্তাহাব।
উপসংহার
পরিশেষে
বলা যায় যে, মুসলিম উম্মাহ সকল ফরয ও ওয়াজিব ইবাদতের ব্যাপারে মতৈক্য পোষণ
করেছে।তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কতিপয় সুন্নাত ও নফল আমলের
ব্যাপারে মতভেদ পরিলক্ষিত হয় যা নিতান্ত নগণ্য। আর এই ধরনের মতবিরোধ জায়েয আছে বলে
শরীয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment