Sunday, 25 August 2013

প্রশ্নঃ খৃষ্ট ধর্মের পরিচয় দাও এবং এই ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি আলোচনা কর।


ভূমিকা

 

মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সত্যের পথে পরিচালিত করার জন্য ধর্মের অনুসরণ অপরিহার্য একটি কাজ। কারণ ধর্ম মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পৃথিবীর অন্য সকল ধর্মের মত খৃষ্টান ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আছে। Religion of Mankind এ বলা হয়েছে,

 

It is the most widely diffused of all religions. 

 

খৃষ্ট ধর্মের পরিচয়

 

ইংরেজী Christ শব্দটি গ্রীক শব্দ Christus থেকে উদ্ভূত যাক্র হিব্রু ভাষায় Messiah বলা হয়। অনেকে তাকে যীশু বলে থাকে।

 

খৃষ্ট শব্দের অর্থ স্বর্গীয় মহামান্বিত ব্যক্তি বা ঈশ্বরের প্রেরিত বা নির্ধারিত।অন্যদিকে যীশু অর্থ হল মুক্তিদাতা।যীশু খৃষ্ট অর্থ হল যীশু তাকে স্বর্গীয় মুক্তিদাতা হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।

 

আল্লামা বায়যাভী বলেন,

 

হিব্রু ভাষায় একে আবশু এবং আরবী ভাষায় একে ঈসা বলা হয়।

 

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটিনিকায় খৃষ্টধর্মের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,

 

এটা সেই ধর্ম যা তার মৌলিকত্বকে নাসিরাবাসী ইয়াসূর সাথে সম্পর্ক করে থাকে এবং তাকে আল্লাহর মনোনীত মাসীহ বলে বিশ্বাস করে। [ব্রিটিনিকা খৃষ্টানিটি,৫ম খণ্ড,৬৯৩ পৃষ্ঠা]

 

আলফ্রেড এ গারভে তার সংজ্ঞাটি এমনিভাবে দেয় যে,

 

এটা এমন এক ঐতিহাসিক,নৈতিক ও একেশ্বরবাদী সার্বজনীন ধর্ম যা প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাস করে এবং যাতে প্রভূ ইয়াসূ মাসীহের ব্যক্তিত্ব ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে তুলে। [এনসাইক্লোপেডিয়া অব রিলিজিয়ন এন্ড এথিকস]

 

তার এই সংজ্ঞাতে খৃষ্টান ধর্মের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা হলঃ

 

এটি একটি

 

 ঐতিহাসিক ধর্ম, নৈতিক ধর্ম,সার্বজনীন ধর্ম এবং একেশ্বরবাদী ধর্ম।

 

হ্যাক্সন স্মিথ বলেন,

 

এই ধর্ম কোন নীতি নয়,কিছু ঘটনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, মূল বিষয়সমূহ ইয়াহূদী হতে এসেছে।

 

ইসলাম ধর্মে খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,

 

নবী ঈসা(আঃ) এর উপর যারা বিশ্বাস এনেছে, একত্ববাদের উপর বিশ্বাস করেছে তারাই খৃষ্টান।

 

কেদারনাথ টেওয়ারি বলেন,

 

Chirstianity can well be regarded as an extension of Judaism in a more elevated direction.

 

Maktolent বলেন,

 

এই ধর্ম ইয়াহূদী ধর্ম মতের উপর ভিত্তি করে খ্রীষ্টের নাম দ্বারা প্রবর্তিত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম।

 

কারও মতে,

 

Christianity is founded on the worship of Jesus Christ as son of God, the every nation and language. 

 

খৃষ্টান ধর্মের বৈশিষ্ট্যবালী

 

১। একত্ববাদে বিশ্বাসীঃ

 

অন্যান্য নবী কর্তৃক প্রেরিত নবী-রাসূলের মত ঈসা(আঃ) তথা যীশু খ্রীষ্ট কর্তৃক প্রচারিত নবীর প্রচারিত ধর্ম একত্ববাদের প্রচার করেছে। তিনি বলেছেন,

 

হে বনী ইসরাঈল, তোমাদের প্রতি আনার প্রথম আজ্ঞা সষ্টিকর্তা এক ও অদ্বীতিয়।তোমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে ভালবাস তাকে। এবং তার উপাসনা কর।

 

বাইবেলে বলা হয়েছে,

 

 I am the first, last the only God there is no God but me.

 

এছাড়া ইঞ্জীল ইওহান্নাতে বলা হয়েছে,

 

প্রথমে কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সাথে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন। [ইওহান্না,১ঃ১-২]

 

২।ত্রিতত্ববাদে বিশ্বাসীঃ

 

খৃষ্টানগণ একশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেও এর উপর ত্রিতত্ববাদের একটি বিশ্বাস বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।তারা তিন খোদাতে বিশ্বাসী যারা হল ইশ্বর,পুত্র ও আত্মা।তারা বিশ্বাস করে ঈশ্বর একজন কিন্তু তার আবির্ভাব ঘটে তিনটি রুপে।তাদের মধ্যকার এই ধারনাটি নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। ইঞ্জীলের ইয়োহান্নাতে বলা হয়েছে,

 

সেই কালাম মানুষ হোয়ে জন্মগ্রহণ করলেন এবং তোমাদের মধ্যে বসবাস করেলন।পিতার একমাত্র পুত্র তার মহিমা,সেই মহিমা আমরা দেখছি। [ইওহান্না,১ঃ১৪]

 

৩। ফেরেশ্তাদের প্রতি বিশ্বাসঃ

 

খৃষ্টানগণ মুসলিমগণের মত ফেরেশ্তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখে।তারা বিশ্বাস রাখে যে, ফেরেশ্তাগণ আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিনিধি।

 

৪। একনিষ্ঠভাবে ইবাদতঃ

 

খৃষ্টানগণ একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকে। বাইবেলে বলা হয়েছে,

 

তোমরা একনিষ্ঠভাবে প্রার্থনা করবে যখন তোমরা প্রার্থনা করবে। ভন্ডদের মত প্রার্থনা করবে না।তারা রাস্তায় মানুষকে দেখানোর জন্য প্রার্থনা করে।তোমরা এমনভাবে প্রার্থনা করবে যেন ঈশ্বর তোমাকে না দেখলেও ঈশ্বরকে তোমাকে দেখছে।

 

৫।সিয়াম সাধনাঃ

 

আত্মশুদ্বি লাভের অন্যতম একটি উপায় হল সিয়াম-সাধনা করা। সিয়াম-সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্বি লাভের জন্য যীশু খৃষ্ট সিয়াম-সাধনার উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।তাই খৃষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে,

 

লোকদের বুঝানোর জন্য মুখ কাল করে রোজা রেখ না বরং এই সময় মাথায় তেল দিও এবং মুখ ধুয়ে ফেল যেন লোকেরা বুঝতে না পারে।

 

৬।আত্মিক পরিশুদ্বতাঃ

 

খৃষ্টান ধর্মে মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্বতা অর্জন করার উপর অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে।খৃষ্টানগণ বিশ্বাস করে যে, আত্মিক পরিশুহদ্বতা ছাড়া কখনও ঈশ্বরের করুনা লাভ করা যায় না। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে,

 

Blessed are those who had a clean hear, they will see God.

 

৭। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ

 

ভালবাসা ও ন্যায়বিচার হল ঈশ্বররের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।যীশু তার শিষ্যদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। বাইবেলে বলা হয়েছে,

 

Blessed are those who hungers and thirsts after righteousness for they shall be filled.

 

৮। প্রতিশ্রুতি রক্ষাঃ

 

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার গুরুত্ব খৃষ্টানধর্মে প্রদান করা হয়েছে। যীশু খৃষ্ট তার অনুসারীদের বলেন,

 

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তোমাদের কর্তব্য।

 

৯। ব্যাভিচার নিষিদ্বঃ

 

খৃষ্ট ধর্মের দৃষ্টিতে ব্যভিচার একটি চরম অন্যায় এবং জঘন্য অপরাধ। শুধুমাত্র সরাসরি ব্যাভিচার নয় বরং , কু-দৃষ্টি প্রদান করা একটি জঘন্য অপরাধ যার দ্বারা ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়। যীশু বলেছেন, যে নারীর দিকে তাকায় সে মনে মনে তার সাথে যিনা করা যা তার অন্তরের পবিত্রতাকে নষ্ট করে ফেলে।

 

১০। সহনশীলতা প্রদর্শনঃ

 

খৃষ্টান ধর্ম একজন অপরের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে বলে থাকে। যীশু বলেন,

 

তোমাদের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ গ্রহণ করবে না।ক্ষমা করে দিও।

 

তার এই উপদেশের দ্বারা খৃষ্ট ধর্মের সহনশীলতার কথা প্রকাশ পায়।

 

১১ধন-সম্পদের সঞ্চয় নয়ঃ

 

খৃষ্ট ধর্মে ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের প্রতি বিশেষভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাই যীশু বলেছন,

 

তোমরা এই পৃথিবীতে নিজেদের জন্য ধন-সম্পদ জমা করে রাখবে না।কারণ নষ্ট হয় ও চুরি হয়। কিন্তু স্বর্গে চুরি হয় না আবার নষ্ট হয় না।

 

১২।অভিপ্রায় শুদ্বিতাঃ

 

যীশু বলেন,

 

স্বর্গে তোমার প্রতি যেভাবে করুনা করা হয় তুমিও সেরকম করুনাময় হও। অর্থাৎ, তোমার অভিপ্রায় সত্য ও সুন্দর।

 

১৩। পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব পালন করাঃ

 

যীশু পিতা-মাতার অধিকার রক্ষা করার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করে বলেছন,

 

তোমরা পিতা-মাতার সাথে সদ্বব্যবহার কর।

 

১৪। স্ত্রী পরিত্যাগ করা সম্পর্কে

 

একান্ত উপায় ছাড়া স্ত্রীকে পরিত্যাগ করা খৃষ্টধর্মের দৃষ্টিতে একটি জঘন্য অপরাধ। যীশু বলেন,

 

যে ব্যাভিচারের কারণ ছাড়া স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে, সে যেন তাকে ব্যাভিচারিনী করে তুলে।

 

১৫। ভ্রাতৃত্ববোধ

 

খৃষ্টান ধর্ম খৃষ্টানদেরকে পারস্পারিক শত্রুতাকে পরিত্যাগ করে ভ্রাতৃত্বময় পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করেছে। যীশু বলেন,

 

যে তোমাদের শত্রু ভাবে তাকে তুমি প্রেম-ভালবাসা দিয়ে জয় করে নাও।তোমরা ঝগড়া-বিবাদ না করে মীমাংশা করে নাও তোমাদের বিরোধসমূহ।

 

১৬।শ্রদ্ধাবোধঃ

 

যীশু খৃষ্ট বড়দের শ্রদ্বা এবং ছোটদের প্রতি আদর যত্ন করার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে।

 

১৭। দোষণ্বেষণ না করাঃ

 

অন্যের দোষ অণ্বেষণ না করে যীশু বলেন,

 

তোমরা দোষ ধর না।কেননা তোমরা যেভাবে দোষারপ করবে,সেভাবে তোমাদেরও দোষ ধরা হবে।     

 

১৮। শরীয়াতের শিক্ষা দেয়া

 

শরীয়াতকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের জন্য যীশু খৃষ্ট প্রেরিত হয়েছেন। নিউ টেষ্টামেন্টে বলা হয়েছে,

 

তোমরা এই কথা মনে করবে না যে আমি তোমাদের মাঝে মূসার শরীয়াত বাতিল করতে আসি এসেছি।বরং, এসেছি পূর্ণ করতে।

 

১৯।ক্রোধ সংবরণঃ

 

যীশু খ্রিষ্ট মানুষকে ক্রোধ সংবরণ করে মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করতে বলেছে। যীশু বলেন,

 

কেউ তোমাকে আঘাত করলে তুমি তাকে আঘাত কর না। ক্রোধ সংবরণ করে তাকে ভালবাসা দাও।সে তার পাপের প্রায়শ্চিত্য পাবে।

 

২০। শপথ করার বিধানঃ

 

খৃষ্টান ধর্মে মিথ্যা শপথ করা নাজায়েয ও অবৈধ। তাই বাইবেলে বলা হয়েছে,

 

মিথ্যা শপথ করবে না,শপথ করলে প্রভূর নামে কর। [মথি,৫ঃ৩৩]

 

২১। প্রতিশোধের শিক্ষাঃ

 

খৃষ্ট ধর্ম মানুষকে শত্রুর প্রতি দয়া-সহাবনুভূতি প্রদর্শন করার কথা বলেছে। যীশু খৃষ্ট বলেন,

 

তোমাদের যদি কেউ ডান গালে চড় মারে তাহলে তাকেও অন্য পেতে দাও চড় দেওয়ার জন্য। [মথি,৫ঃ৩৭]

 

তোমরা শত্রুদের ভালবাস এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর যাতে তোমরা স্বর্গীয় পিতা হতে পার।

 

২২। উপাসনার মূলনীতি ও পদ্বতিঃ

 

খৃষ্ট ধর্ম দীক্ষিত লোকেরা চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে উপাসনা করে থাকে যা হল মাসীহ(আঃ) যেই ত্যাগ-তীতিক্ষা স্বীকার করেছে তা কেবলমাত্র ঈশ্বরের শোকরানার জন্য, সঠিক উপাসনা রুহের দ্বারা পাওয়া সম্ভব, উপাসনা একটি সমষ্টিগত কর্ম যা চার্চে সম্পন্ন হয় এবং উপাসনা হল চার্চের মূল কাজ এরই মাধ্যমে চার্চ মাসীহের দেহ হিসেবে নিজেকে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করে। খৃষ্টানগণ প্রশংসা পাঠ এবং ব্যাপটাইজের মাধ্যমে উপাসনা করে থাকে।

 

উপসংহার

 

পরিশেষে বলা যায় যে, খৃষ্টান ধর্ম মানুষকে শান্তি ও নৈতিকতার শিক্ষা প্রদান করে থাকে।ইয়াহূদী ধর্মের অনেকে শিক্ষা-দীক্ষার সাথে এর মিল রয়েছে। বর্তমানে এর অনেক বিশ্বাসসমূহ বিকৃতি হয়ে গিয়েছে।

1 comment:

৩৮ তম বিসিএস এর রেজাল্ট

৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এ কথা নিশ্চিত করেন। ...