ভূমিকা
হিন্দুধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম তথা একটি দেশীয় ধর্মবিশ্বাস।হিন্দু
ধর্মাবলম্বীগণ স্বীয় ধর্মমতকে সনাতন ধর্ম নামেও অভিহিত করেন।হিন্দুধর্ম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম তবে হিন্দু
নামটি আধুনিকালের দেওয়া। এর প্রাচীন নাম
হল সনাতন ধর্ম। আবার এই ধর্ম বৈদিক ধর্ম নামেও পরিচিত। এই ধর্ম বেদ এর উপর ভিত্তি
করে গড়ে উঠেছিল। এ ধর্মত্ত্বের মূল কথা
হল ঈশ্বরের অস্তিত্বেই সকল কিছুর অস্তিত্ব এবং সকল কিছুর মূলেই স্বয়ং ঈশ্বর। হিন্দুধর্মের সাধারণ "ধরনগুলির" মধ্যে লৌকিক ও বৈদিক
হিন্দুধর্মথেকে বৈষ্ণবধর্মের অনুরূপ ভক্তিবাদী ধারার মতো একাধিক জটিল মতবাদগুলির
সমন্বয়ের এক প্রচেষ্টা লক্ষিত হয়।যোগ, কর্মযোগ ধারণা, ও হিন্দু বিবাহের মতো বিষয়গুলিও
হিন্দুধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
হিন্দু শব্দটির উৎপত্তি
হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এই ধর্মের
কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। লৌহযুগীয় ভারতেরঐতিহাসিক বৈদিক ধর্মে এই ধর্মের শিকড় নিবদ্ধ। হিন্দুধর্মকে বিশ্বের "প্রাচীনতম
জীবিত ধর্মবিশ্বাস" মতবাদ আখ্যা দেওয়া হয়।
অনেকের মতে হিন্দু শব্দটি আর্যদেরকে আফগানিস্তানের বাসিন্দা বা আফগানেরা দিয়েছে
তারা সিন্দু নদের তীরবর্তীসনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিদেরকে হিন্দু বলত, আর এই ভাবেই হিন্দু নামটি এসেছে।কিন্তু এই তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে সত্যতা নিশ্চিত করে না।
হিন্দু শব্দটি উৎসারিত হয়েছে
সংস্কৃত সিন্ধু শব্দটি থেকে। সিন্ধু ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদীর নাম ঋগ্বেদে সিন্ধু
নদের স্তুতি করা হয়েছে। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও আল-হিন্দ শব্দটির মাধ্যমে
সিন্ধু নদ অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে।প্রকৃতপক্ষে ৭১২ খৃষ্টাব্দে যখন মুহাম্মদ বিন
কাসিম সিন্ধু প্রদেশ জয় করেন তখন থেকে
তাদের মধ্যে সিন্ধুর স্থলে হিন্দ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন ঘটে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে
ভারতের নামের সমার্থক শব্দ হিসেবে
হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান শব্দটির উৎপত্তি হয়। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ "হিন্দুদের দেশ"।
হিন্দু ধর্মের সংজ্ঞা ও পরিচিতি
প্রথমদিকে হিন্দু শব্দটি
ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কেবলমাত্র চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত ইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর
বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা
ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা
ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে হিন্দু নামে অভিহিত করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটি আব্রাহামীয় ধর্মসমূহ
অথবা অবৈদিক ধর্মবিশ্বাসগুলির (যেমন
জৈনধর্ম,
বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম) অনুগামী নন এবং সনাতন ধর্ম নামক
ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়ে পড়ে।
ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে হিন্দুইজম বা
হিন্দুধর্ম কথাটি চালু হয় ঊনবিংশ
শতাব্দীতে।[
ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি তথা বিশিষ্ট দার্শনিক সর্বপল্লী
রাধাকৃষ্ণন হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দিতে
গিয়ে একে “একটি
বিশ্বাসমাত্র” বলতে অস্বীকার
করেন। বরং এই ধর্মের যুক্তি ও দর্শনের দিকটি বিচার করে তিনি খোলাখুলিভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন যে
হিন্দুধর্মের সংজ্ঞা দান করা অসম্ভব।
শুধুমাত্র এই ধর্ম অনুশীলনই করা যায়। তার মতে হিন্দুত্বকে ধর্ম না বলে
জীবন ব্যবস্থা বলা উত্তম।
একই ধরনের মতামত মহাত্মা গান্ধী প্রদান করে বলেছেন, হিন্দুত্বের সকল মানুষকে নিজ নিজ বিশ্বাসের অনুবর্তী থেকে ঈশ্বরের উপাসনা করা যায়।এভাবে
করে অন্যান্য ধর্মের লোকদের পাশাপাশি
স্বীয় ধর্ম পালনের মধ্য দিয়ে শান্তি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করে জাগতিক তৃপ্তি লাভ করা যায়।
তেমনই কোনো কোনো পণ্ডিত সুসংজ্ঞায়িত ও রক্ষণশীল ধর্মীয় সংগঠন না বলে
হিন্দুধর্মকে “অস্পষ্ট
সীমানায়” বর্গায়িত করার পক্ষপাতী। কয়েকটি ধর্মমত হিন্দুধর্মে কেন্দ্রীয়। অন্যগুলি ঠিক
কেন্দ্রীয় না হলেও এই পরিসীমার আওতার
মধ্যেই পড়ে। এরই ভিত্তিতে ফেরো-লুজি হিন্দুধর্মের সংজ্ঞায়নে একটি “উদাহরণমূলক তাত্ত্বিক অন্বেষণ” (“প্রোটোটাইপ থিওরি অ্যাপ্রোচ”) চালিয়েছেন।
তাই শ্রীগোবিন্দ দাস বলেন
No definition is possible
for religion, because it is undefined. [Hinduism: 45]
একই সুরে রাধাকৃষ্ণ এভাবে সংজ্ঞা প্রদান করে বলেছেন,
Nothing is more difficult to be defined than Hinduism.
শ্রী গিরির মতে,
বেদে স্বপ্রমিত ও সতঃসিদ্ব
সত্যরাজি নিহিত এই কথা যে বিশ্বাস করে
সেই হিন্দু আর তার এই ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বলে।
স্বামী শ্রী বিষ্ণু শিবানান্দ
গিরী তার রচিত হিন্দু ধর্মের প্রবেশিকায় লিখেছেন,
কিন্তু এই বক্তব্য সঠিক নয়।কারণ
ভারতের লোকেরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ধর্ম তথা
বৌদ্ব,জৈন,ব্রাহ্ম,বিষ্ণু
প্রভ্রৃতি ধর্মের অনুসারী হওয়া শুরু করে। তাই ভ্যানকাটা রমন বলেন,
যেসব ব্যক্তি ইসলাম,জৈন,বৌদ্ব,খ্রীষ্টান,পার্সী,ইয়াহূদী যা জগতের
অন্যান্য ধর্মের অন্তর্ভূক্ত নয় এবং যাদের উপাসনার রুপ একেশ্বরবাদ থেকে ফেটিশবাদ পর্যন্ত প্রসারিত এবং যার ধর্মতত্ত্ব
সম্পূর্ণরুপে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত তাদেরকে হিন্দু রুপে এবং তাদের অবলম্বিত ধর্ম হল হিন্দু ধর্ম।
ড. পরেশমণ্ডল ও ড. দিলীপ কুমাড়
ভট্টাচার্য বলেন,
বৈদিক এবং বেদ অনুমোদিত পৌরাণিক
আদর্শ যারা সমাদর করে,বেদে ধর্মীয় শাস্ত্রানানোমোদিত বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা
ধর্ম সাধনা,উপাসনা করেন এবং সনাতন ধর্মের কল্যাণ চিন্তাকে জীবনের
প্রয়োগ করে,জীবন-যাপন করে তারা হিন্দু আর তাদের ধর্মে হল হিন্দু।
স্বামী বিষ্ণু বলেন
যিনি বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায়
নিষ্ঠাবান,গোবৎস বেদকে মাতৃতুল্য মনে করেন, দেবমূর্তিকে অবজ্ঞা করেন না,সকল ধর্মকে সমাদর করেন,পুনর্জন্মে বিশ্বাসী,সর্বজীবকে আত্মপৎ মনে করেন,তিনিই হিন্দু।
Oxford Dictionary তে বলা হয়েছে,
The main religion social system of India, which meludes the worship of several Gods and in reincarnation. [Hinduism]
Encyclopedia of Britannica তে বলা
হয়েছে,
The name of Hinduism means the civilizations of the hindu. Originally the inhabitants of the
land of the land of Indus rivers.
উনবিংশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদীগণ ‘হিন্দু-ইজম’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করার পর থেকেই হিন্দুধর্ম একটি
বিশ্বধর্ম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।এছাড়াও
শব্দটির প্রাথমিক প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ বা ‘প্রথম
যুগের ভারততত্ত্ববিদগণ’, যাঁদের বক্তব্য সাধারণত একপেশে ছিল বলে মনে করা হয়। যদিও হিন্দুধর্মের শিকড় ও তার বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার প্রাচীনত্বের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। সকলেই
স্বীকার করেছেন যে প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু
সভ্যতা থেকে ঐতিহাসিক বৈদিক সভ্যতার প্রাথমিক পর্ব জুড়ে ছিল হিন্দুধর্মের সূচনালগ্ন। কেবলমাত্র ধর্মবৈভিন্ন প্রদর্শনের
উদ্দেশ্যে বৈদিক সংস্কারের ভিত্তিতে
হিন্দুধর্মের একটি রূপ দান করেছেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণ – এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তা সত্য নয়।
পাশ্চাত্য দৃষ্টিকোণ থেকে, ধর্ম কি এবং কিভাবে তা আরও প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত
তারই বিচারে হিন্দুধর্মকে যাচাই করা হয়।
‘ধর্মবিশ্বাস’ (‘ফেইথ’) শব্দটি ‘ধর্ম’ (‘রিলিজিয়ন’) অর্থে প্রয়োগের ফলে এই বিষয়ে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। কোনো কোনো পণ্ডিত এবং অনেক হিন্দু দেশীয় ‘সনাতন ধর্ম’-এর সংজ্ঞাটির পক্ষপাতী।এই সংস্কৃত শব্দবন্ধটির অর্থ ‘চিরন্তন ধর্ম (বিধি)’ বা ‘চিরন্তন পন্থা।
এই ধর্মের অন্যান্য নামসমূহ হল
আর্য,সনাতন,বর্ণাশ্রম ও ব্রাহ্ম ইত্যাদি।
নিম্নে হিন্দু ধর্মের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো
আলোচিত হল:
অবতারবাদে বিশ্বাসঃ
হিন্দু ধর্ম
অবতারবাদে বিশ্বাসী। অবতার অর্থ হলো
অবতরণকারী। হিন্দুশাস্ত্রের পরিভাষায় স্বর্গ
থেকে ঈশ্বর মনোনীত যে মহাপুরুষগণ মানুষকে নীতি শিক্ষাদানের জন্য মর্তে আগমন
করেন তাঁদেরকে অবতার বলা হয়। সাধারণত
জগৎ-জীবনকে দিব্য প্রকৃতিতে উঠাবার এবং
ধর্ম সংস্থাপন ও অধর্মের বিনাশের জন্য ঈশ্বরের পক্ষ থেকে অবতারগণ আগমন করে থাকেন।
পরস্পর বিরোধী বিশ্বাসের সহাবস্থান:
হিন্দু ধর্মে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্ম বলতে কোন একটি বিশেষ ধরনের ধর্ম সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতাকে বুঝায় না; বরং এ ধর্মে বিভিন্ন মনীষী ও মাহপুরুষদের দ্বারা প্রাপ্ত ধর্ম সম্বন্ধীয় বিভিন্ন অভিজ্ঞতার একত্র সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। কাজেই এই ধর্মে পরস্পর বিরোধী বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়। এ ধর্ম পরস্পর বিরোধী বিশ্বাসের সহাবস্থান সম্বলিত বৈচিত্র্যময় ধর্ম। এমন বিচিত্র ব্যাপার প্রচলিত ধর্মসমূহের আর কোনটিতেও দেখা যায় না।
জরা জীবন থেকে মুক্তি লাভে বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস হল,
(ক) কর্মের মাধ্যমে এবং
(খ) জ্ঞানের মাধ্যমে জাগতিক জরা জীবন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
এ ধর্মের নীতি হল, নিষ্কাম সাধনা, অর্থাৎ কর্তব্যের খাতিরে মরে যাও, তবুও ফলের আশা করো না। এ ধর্ম বলে, কর্মের মাধ্যমে যে মুক্তি লাভ করা যায় তা হল স্বর্গলাভ।
(গ) এতে আরো মনে করা হয়, ঈশ্বরের করুণার মাধ্যমেও মুক্তি লাভ করা যায়।
পুনর্জন্ম মতবাদে বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুনর্জন্মে বিশ্বাস। পুনর্জন্মের অর্থ হলো জীবের মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহ ধারণ করে পুনঃপুনঃ পৃথিবীতে আগমন করবে। গীতায় বলা হয়েছে, ‘‘মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে অন্য নতুন দেহ গ্রহণ করবে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস হল পুনর্জন্মবাদ যা অদ্বৈতবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। প্রাচীন বৈদিক যুগে এর অস্তিত্ব ছিল না।তখন পর্যন্ত হিন্দুদের ভিতর এই জড়-পার্থিব জীবন সম্পর্কে আশাবাদী দৃষ্টিকোণ ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, মৃত্যুর পর তারা চিরকাল চালু থাকবে। তাদের ধারনা ছিল এমন যে, মৃত্যুর পর তারা পূণ্য কাজের জন্য স্বর্গে প্রবেশ করবে আর মৃত্যুর পর তারা নরকে প্রবেশ করবে যদি তারা ভাল কাজ সম্পন্ন না করে যায়।কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা তাদের এই ধ্যান-ধারনাকে বিসর্জন দিয়ে পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এই পুনর্জন্মে তাকে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। আর এই ধারা অনন্তকাল পর্যন্ত বিরাজমান থাকবে। এই ধ্যান-ধারনা হিন্দুদের হীনবল ও নিম্নমুখী করে তুলে।তার উপর এক হতাশাব্যঞ্জক ঔদাসীন্য মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।উপরুন্ত এই বিশ্বাস থেকেই অদৃষ্টবাদের রপগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মানুষের ভাগ্য তার পুনর্জন্মবাদের দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। শত চেষ্টা করলেও তা পরিবর্তন করতে পারবে না। মানুষ তার কৃতকর্মের দরুন নিম্ন জীব-জানোয়ারের রুপে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
অদ্বৈতবাদ :
হিন্দুধর্মে আরাধ্যের আধিক্য তার অদ্বৈতবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। অদ্বৈতবাদ হল সকল দেব-দেবী ও সকল প্রাকৃতিক শক্তি যেমনঃ বায়ু, পানি,নদী,ভূমিকম্প,মহামারী ইত্যাদি এক একক প্রাণশক্তির বিভিন্নরুপ আছে।
কর্মবাদে বিশ্বাস:
কর্মবাদ অনুসারে মানুষকে অবশ্যই তার নিজ কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। যেমন- সৎকর্মের ফল পুণ্য বা সুখ এবং অসৎ কর্মের ফল পাপ ও দুঃখ।
অধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্ম আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী।
ঈশ্বরের প্রতি বিভিন্নধর্মী বিশ্বাস:
ঈশ্বরের আকার প্রসঙ্গে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই ধর্ম বিভিন্ন মতবাদ পোষণ করে। হিন্দুদের বড় তিনজন দেবতা হল ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও শিব। এদের আওতাধীন রয়েছে আবার অসংখ্য দেব-দেবী। তাদের বিশ্বাস হল এই যে, ব্রহ্মা হল বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিষ্ণু পালনকর্তা এবং শিব সংহারকর্তা। হিন্দুগণ বিশ্বাস করে যে, বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পর থেকে ব্রহ্মার সাথে সৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই।তাই তারা শিব ও বিষ্ণুর উপাসনা করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে তারা একাধিক কেউ নয় বরং তারা সকলে একই সত্ত্বার অধীনভূক্ত।তারা এভাবে করে একেশ্বরবাদের বিশ্বাসী।কিন্তু কেউ শিবের প্রতি আবার কেউ বিষ্ণুর প্রতি অতি গুরুত্বারোপ করে থাকে। এভাবে করে তাদের ভিতর নানা সম্প্রদায় তথা বৈষ্ণব,ব্রাহ্মণ,শৈব্য,শাত্য ও গানপতা সম্প্রদায় লক্ষ্য করা যায়।
পরস্পর বিরোধী বিশ্বাসের সহাবস্থান:
হিন্দু ধর্মে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু ধর্ম বলতে কোন একটি বিশেষ ধরনের ধর্ম সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতাকে বুঝায় না; বরং এ ধর্মে বিভিন্ন মনীষী ও মাহপুরুষদের দ্বারা প্রাপ্ত ধর্ম সম্বন্ধীয় বিভিন্ন অভিজ্ঞতার একত্র সংযোগ লক্ষ্য করা যায়। কাজেই এই ধর্মে পরস্পর বিরোধী বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়। এ ধর্ম পরস্পর বিরোধী বিশ্বাসের সহাবস্থান সম্বলিত বৈচিত্র্যময় ধর্ম। এমন বিচিত্র ব্যাপার প্রচলিত ধর্মসমূহের আর কোনটিতেও দেখা যায় না।
জরা জীবন থেকে মুক্তি লাভে বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস হল,
(ক) কর্মের মাধ্যমে এবং
(খ) জ্ঞানের মাধ্যমে জাগতিক জরা জীবন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
এ ধর্মের নীতি হল, নিষ্কাম সাধনা, অর্থাৎ কর্তব্যের খাতিরে মরে যাও, তবুও ফলের আশা করো না। এ ধর্ম বলে, কর্মের মাধ্যমে যে মুক্তি লাভ করা যায় তা হল স্বর্গলাভ।
(গ) এতে আরো মনে করা হয়, ঈশ্বরের করুণার মাধ্যমেও মুক্তি লাভ করা যায়।
পুনর্জন্ম মতবাদে বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুনর্জন্মে বিশ্বাস। পুনর্জন্মের অর্থ হলো জীবের মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহ ধারণ করে পুনঃপুনঃ পৃথিবীতে আগমন করবে। গীতায় বলা হয়েছে, ‘‘মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে অন্য নতুন দেহ গ্রহণ করবে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস হল পুনর্জন্মবাদ যা অদ্বৈতবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। প্রাচীন বৈদিক যুগে এর অস্তিত্ব ছিল না।তখন পর্যন্ত হিন্দুদের ভিতর এই জড়-পার্থিব জীবন সম্পর্কে আশাবাদী দৃষ্টিকোণ ছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, মৃত্যুর পর তারা চিরকাল চালু থাকবে। তাদের ধারনা ছিল এমন যে, মৃত্যুর পর তারা পূণ্য কাজের জন্য স্বর্গে প্রবেশ করবে আর মৃত্যুর পর তারা নরকে প্রবেশ করবে যদি তারা ভাল কাজ সম্পন্ন না করে যায়।কিন্তু কিছুদিন পরেই তারা তাদের এই ধ্যান-ধারনাকে বিসর্জন দিয়ে পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এই পুনর্জন্মে তাকে কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হয়। আর এই ধারা অনন্তকাল পর্যন্ত বিরাজমান থাকবে। এই ধ্যান-ধারনা হিন্দুদের হীনবল ও নিম্নমুখী করে তুলে।তার উপর এক হতাশাব্যঞ্জক ঔদাসীন্য মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।উপরুন্ত এই বিশ্বাস থেকেই অদৃষ্টবাদের রপগ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ মানুষের ভাগ্য তার পুনর্জন্মবাদের দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। শত চেষ্টা করলেও তা পরিবর্তন করতে পারবে না। মানুষ তার কৃতকর্মের দরুন নিম্ন জীব-জানোয়ারের রুপে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
অদ্বৈতবাদ :
হিন্দুধর্মে আরাধ্যের আধিক্য তার অদ্বৈতবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। অদ্বৈতবাদ হল সকল দেব-দেবী ও সকল প্রাকৃতিক শক্তি যেমনঃ বায়ু, পানি,নদী,ভূমিকম্প,মহামারী ইত্যাদি এক একক প্রাণশক্তির বিভিন্নরুপ আছে।
কর্মবাদে বিশ্বাস:
কর্মবাদ অনুসারে মানুষকে অবশ্যই তার নিজ কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। যেমন- সৎকর্মের ফল পুণ্য বা সুখ এবং অসৎ কর্মের ফল পাপ ও দুঃখ।
অধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস:
হিন্দু ধর্ম আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী।
ঈশ্বরের প্রতি বিভিন্নধর্মী বিশ্বাস:
ঈশ্বরের আকার প্রসঙ্গে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই ধর্ম বিভিন্ন মতবাদ পোষণ করে। হিন্দুদের বড় তিনজন দেবতা হল ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও শিব। এদের আওতাধীন রয়েছে আবার অসংখ্য দেব-দেবী। তাদের বিশ্বাস হল এই যে, ব্রহ্মা হল বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিষ্ণু পালনকর্তা এবং শিব সংহারকর্তা। হিন্দুগণ বিশ্বাস করে যে, বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পর থেকে ব্রহ্মার সাথে সৃষ্টির কোন সম্পর্ক নেই।তাই তারা শিব ও বিষ্ণুর উপাসনা করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে তারা একাধিক কেউ নয় বরং তারা সকলে একই সত্ত্বার অধীনভূক্ত।তারা এভাবে করে একেশ্বরবাদের বিশ্বাসী।কিন্তু কেউ শিবের প্রতি আবার কেউ বিষ্ণুর প্রতি অতি গুরুত্বারোপ করে থাকে। এভাবে করে তাদের ভিতর নানা সম্প্রদায় তথা বৈষ্ণব,ব্রাহ্মণ,শৈব্য,শাত্য ও গানপতা সম্প্রদায় লক্ষ্য করা যায়।
বেদে অকুণ্ঠ বিশ্বাস:
এ ধর্মের অনুসারীরা ঐশ্বীগ্রন্থরূপে বেদের অস্তিত্ব এবং কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে।তাছাড়া বর্তমানে হিন্দু ধর্ম তার পুরাণ তথা প্রাচীন শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। এগুলো হল প্রাচীন ধর্মলিপি। এগুলোতে বিশ্ব সৃষ্টির অনেক কাহিনী লিপিবদ্ব আছে।
ভিন্ন ধারার একেশ্বরবাদ:
হিন্দু ধর্মে অসংখ্য দেবদেবীর অস্তিত্ব থকলেও মূলত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। এ ধর্ম এক পরম আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাসী। এ ধর্ম মনে করে যে, পরম ঈশ্বর বহু ঈশ্বরের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কাজেই হিন্দু ধর্ম প্রচলিত সকল ধর্মে বিশ্বাসের বাইরে এক বিশেষ ধরনের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
বর্ণশ্রমে বিশ্বাস:
এ ধর্মে বর্ণাশ্রমের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলা হয়। যা হল ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র।হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকে যে, ব্রাহ্মণরা স্রষ্টার মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়রা স্রষ্টার বাহু থেকে, বৈশ্যরা উরু থেকে, শুদ্ররা স্রষ্টার পা থেকে সৃষ্টি। এখানে ব্রাক্ষণদের কাজ হল ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব বহন করবে, ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ব পরিচালনা ও দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকবে, বৈশ্যগণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি কার্য সম্পাদন করবে এবং শুদ্রগণ উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সম্প্রদায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবে।
এ ধর্মের অনুসারীরা ঐশ্বীগ্রন্থরূপে বেদের অস্তিত্ব এবং কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে।তাছাড়া বর্তমানে হিন্দু ধর্ম তার পুরাণ তথা প্রাচীন শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। এগুলো হল প্রাচীন ধর্মলিপি। এগুলোতে বিশ্ব সৃষ্টির অনেক কাহিনী লিপিবদ্ব আছে।
ভিন্ন ধারার একেশ্বরবাদ:
হিন্দু ধর্মে অসংখ্য দেবদেবীর অস্তিত্ব থকলেও মূলত একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। এ ধর্ম এক পরম আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাসী। এ ধর্ম মনে করে যে, পরম ঈশ্বর বহু ঈশ্বরের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কাজেই হিন্দু ধর্ম প্রচলিত সকল ধর্মে বিশ্বাসের বাইরে এক বিশেষ ধরনের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।
বর্ণশ্রমে বিশ্বাস:
এ ধর্মে বর্ণাশ্রমের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলা হয়। যা হল ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র।হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকে যে, ব্রাহ্মণরা স্রষ্টার মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়রা স্রষ্টার বাহু থেকে, বৈশ্যরা উরু থেকে, শুদ্ররা স্রষ্টার পা থেকে সৃষ্টি। এখানে ব্রাক্ষণদের কাজ হল ধর্মীয় দায়-দায়িত্ব বহন করবে, ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ব পরিচালনা ও দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত থাকবে, বৈশ্যগণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি কার্য সম্পাদন করবে এবং শুদ্রগণ উপরোক্ত তিন শ্রেণীর সম্প্রদায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবে।
জীবনের স্তরবিন্যাস:
হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে, মানুষের জীবনের স্তর চারটি। যেমন-
ক. ব্রহ্মচর্য: এ স্তর জন্ম থেকে ২৫ বছরকাল পর্যন্ত। এ স্তরে মানুষ লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকবে।
খ. গার্হস্থ্য: এ স্তর ২৫ থেকে ৫০ পর্যন্ত স্থায়ী। এ সময়ে সংসার ধর্ম পালন করবে।
গ. বানপ্রস্থ: এ স্তর ৫০ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত। এই সময়ে মানুষ তৃতীয় আশ্রম তথা নির্জনবাসে ঈশ্বরের ধ্যানমগ্ন থাকবে।
ঘ. সন্ন্যাস: এ স্তর ৭৫ বছর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত। এ সময়ে মানুষ সংসার থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে ঈশ্বর লাভে জপ-তপ করবে।
হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস করে, মানুষের জীবনের স্তর চারটি। যেমন-
ক. ব্রহ্মচর্য: এ স্তর জন্ম থেকে ২৫ বছরকাল পর্যন্ত। এ স্তরে মানুষ লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকবে।
খ. গার্হস্থ্য: এ স্তর ২৫ থেকে ৫০ পর্যন্ত স্থায়ী। এ সময়ে সংসার ধর্ম পালন করবে।
গ. বানপ্রস্থ: এ স্তর ৫০ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত। এই সময়ে মানুষ তৃতীয় আশ্রম তথা নির্জনবাসে ঈশ্বরের ধ্যানমগ্ন থাকবে।
ঘ. সন্ন্যাস: এ স্তর ৭৫ বছর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত। এ সময়ে মানুষ সংসার থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে ঈশ্বর লাভে জপ-তপ করবে।
হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
কারো মতে, হিন্দু ধর্মের ক্রমবিকাশ সূচনা হয় বৈদিক যুগ থেকেই। বেদের যুগ ছিল খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে।
আবার কোন কোন গবেষক মনে করেন
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে, মধ্য এশিয়া থেকে আসা আর্য
জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে যে ধর্মাচারণের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, তারই এক পরিবর্তিত রূপ
আজকের হিন্দুধর্ম। খ্রীস্টপূর্ব ৫৫০০-২৬০০ অব্দের দিকে যখন কিনা হাপ্পান
যুগ ছিল ঠিক সেই সময়ই এ ধর্মের গোড়ার দিক। অনেকের মতে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০
অব্দ। কিন্তুইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে আর্য বা Aryan জাতিগোষ্ঠি ইউরোপের মধ্য দিয়ে ইরান হয়ে ভারতে প্রবেশ করে খ্রীস্টপূর্ব
৩০০০-২৫০০ অব্দের মধ্যে, তারাই ভারতে বেদ
চর্চা করতে থাকে এবং তারা সমগ্র ভারতে তা ছড়িয়ে দেয়। সেই সূত্রে আর্যদের
প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ— হিন্দু ধর্মের প্রধান
আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়।আর্যগণ প্রথমে উত্তর ভারতে সিন্ধুতে অবস্থান
শুরু করে। এরপর তারা উত্তর প্রদেশে বসতি
গড়ে তুলে।এখান থেকে উত্তর ভারতে হিন্দু ধর্মের
ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে।এই সময় এই ধর্ম আর্য্যবর্ত নামে পরিচিতি
ছিল।কালক্রমে তারা বিন্ধা পর্বত অতিক্রম
করে দক্ষিণ ভারতের দিকে আসতে থাকে এবং হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। আর্য জাতিগোষ্ঠিরা অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলত।
তারা চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল এরা হলঃ ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং
শুদ্র। এই সম্প্রদায়গুলো তৈরি করার অন্যতম কারণ হল কাজ ভাগ করে নেওয়া অর্থাৎ এক
এক সম্প্রদায় এর লোক এক এক ধরনের কাজ করবে। ।এই ধর্মের যেহেতু কোন সুনির্দিষ্ট
উদ্ভাবক নেই তাই এই ধর্মের উৎপত্তি
সংক্রান্ত প্রকৃত দিন তারিখ নির্ণয় করা একটি দুরুহ কাজ। তাই কেদারনাথ তিওয়ারী বলেন,
এই ধর্মের উৎপত্তির না কোন সঠিক তারিখ আছে না কোন সুনির্দিষ্ট
প্রবর্তক আছেন।
হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক কোন বিশেষ
নয়। যরদুশত,মূসা,ঈসার মত এমন কোন
ব্যক্তির উপর সন্ধান পাওয়া যায় না।যাকে হিন্দু
ধর্মের প্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তেমনিভাবে হিন্দু ধর্মের
গ্রন্থাবলী কোণ নির্দিষ্ট
ব্যক্তি-সংক্লিষ্টের সাথে সম্পৃক্ত নয়। পরবর্তীতে কিছু ব্যক্তি বিশেষের আগমন ঘটলেও হিন্দুধর্মের সূচনাপূর্বে
নৈর্ব্যক্তিগণ সীলমোহরে লেগে আছেন।
যেহেতু হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় ব্যবস্থা সংগঠনে অসংখ্য ব্যক্তিত্ব
অংশগ্রহণ করেছেন, যার ফলে এই ধর্মে একক কোন বিশ্বাস,ধর্মীয় রীতি-নীতি বা আচার অনুষ্ঠান লক্ষ্য করা যায় না। বিশ্বাসের বৈচিত্র্য,উপাসনা পদ্বতির বিভিন্নতা এবং আরাধ্যের আধিক্যের জন্য এই ধর্মকে এমন এক গহীন অরণ্যের মত মনে হয়,যেখানে হাজারো পথ রয়েছে।
তাই স্যার চার্লস এলিয়ট বলেন,
Hinduism has not been made, but has grown,it is a jungle not a building.
কে.এম সেন বলেন,
হিন্দুত্ববাদ হল এমন ধর্ম যা
একটি বৃক্ষের ন্যায় যা অনেকদিন যাবৎ গড়ে
উঠেছে যেমনটি একটি দালান নির্মাণে অনেকদিন সময় লাগলে তার স্থাপত্য নির্ধারণ করা একটি দুরুহ কাজ।
কিন্তু কোন পথ সঠিকভাবে সরল ও
পরিচ্ছন্ন নয়।
যখন আর্যহিন্দুগণ সর্বপ্রথন ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে তখন তাদের
ধ্যান-ধারনা ছিল নেহায়াত সাদামাঠা। ঐসব ধ্যান-ধারনা ও বিশ্বাস বেদসমূহে সঙ্কলিত
হয়েছে। কিন্তু সেই সময় থেকে তা এক বিশেষ
ধর্মীয় শ্রেণী অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের
ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা
তাদের ধর্মীয় নেতৃত্বকে বৈধ করার জন্য যেসকল গ্রন্থ রচনা শুরু করে তাদের
ব্রাহ্মণ্য বলা হয়। ব্রাহ্মণ্যকে বৌদ্ব ও
জৈন ধর্মগ্রন্থের সাথে তুলনা করলে উপলব্দ্বি করলে এই বিষয়টি প্রতীয়মান হয় যে, তাতে তত্ত্ব ও
তথ্যসমূহ বিকৃতি করা হয়েছে এবং পুরাতন বৈদিক বিশ্বাসসমূহ এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে, যাতে ব্রাহ্মণদের পৌরসাহিত্যের ধারাবাহিকতা সপ্রমাণিত
হয়। এইজন্যে হিন্দু ধর্মের সেইসকল
গ্রন্থসমূহের সঠিক প্রতিনিধিত্ব হয় নাই। জৈন ও
বৌদ্ব মতবাদরুপে যে নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের সৃষ্টি হয়,ব্রাহ্মণ্যে তা সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে চলা হয়।খ্রিস্টপূর্ব
ষষ্ঠ শতকে প্রবর্তিত হয় বৌদ্ধ ধর্ম। এই
ধর্ম প্রাথমিক ভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ
উদ্ভুত হলেও, একটা সময়ের পরে, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর, এর মধ্যেও তন্ত্র-মন্ত্রজাত বিভিন্ন
সংস্কার প্রবেশ করে। হিন্দু ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও রয়েছে অজস্র তন্ত্র-গ্রন্থ। বৌদ্ধেরা হিন্দুদের তথাকথিত দেবদেবীতে বিশ্বাসী না হলেও হিন্দু তন্ত্রকে
তারা শুধু গ্রহণই করেনি, তাকে আরও পরিশীলিত
ও পরিমার্জিত করেছিল বলা যায়।হিন্দু
ধর্ম থেকে আরেক ক্ষত্রিয় পুত্র জৈন ধর্মের প্রবর্তন করেন যদিও তা বৌদ্ব
ধর্মের ন্যায় ব্যাপকভাবে প্রসারতা লাভ
করতে পারে নাই। হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় কোন শূন্যতা সৃষ্টি হয়
নাই। তেমনিভাবে এই ধর্মগ্রন্থসমূহে
উপমহাদেশে গ্রীক, শক,হুন ইত্যাদি জাতির হামলার কথা উল্লেখ করা হয় নাই।
এই সনাতন ধর্মের সাধু সন্ন্যাসিরাই বেদ
শ্রুতিবদ্ধ করেন অর্থাৎ ধ্যানের মাধ্যমে বেদ আয়ত্ব করেন। বেদ কোন একজন সাধু বা
সন্ন্যাসির লব্ধকৃত নয়, বেদ হল বহু সাধু
সন্ন্যাসিদের লব্ধকৃত এক মহান শ্রুতিবদ্ধ
গ্রন্থ যা প্রথম অবস্থায় সবার মনে মনে
ছিল পরে তাকে লিপিবদ্ধ করা হয়। বেদ এই লিঙ্কটির মাধ্যমে বেদ সম্পর্কে আরো জানতে
পারবেন। তখন কার যুগে এই বেদের আধিপত্য ছিল ব্যাপক, অর্থাৎ সমাজের সকল কাজ বেদের মাধ্যমে
চলত কারণ বেদে সমাজ চালানো, চিকিৎসা করা, গণনা করা এমন সব
উপাদানই আছে। এই কারনে তখনকার সভ্যতাকে বলা হয় বৈদিক সভ্যতা। এই বৈদিক সভ্যতায় অর্থাৎ ঐ আমলে কোন
মূর্তি পুজা করা হত না। সেই সময় হিন্দুদের প্রধান দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি এবং সোম।
তারা যজ্ঞের মাধ্যমে পূজিত হত। তখনকার ঈশ্বর আরাধনা হত যজ্ঞ এবং বেদ পাঠের
মাধ্যমে। সকল কাজের আগে যজ্ঞ করা ছিল বাঞ্ছনীয়। সে আমলে কোন মূর্তি বা মন্দির ছিল
না। ।আর্যদের এ দেশে আসার আগে এখানকার
অধিবাসীদের মধ্যে যে সমস্ত ধর্মাচারণ ছিল, মূর্তিপুজো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আর্যরা এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যতই মিশে যেতে থাকে, এখানকার প্রাচীন
আচার-ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচরণ
আর্য-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে তত বেশি মাত্রায়। এই সময়কাল
থেকেই ঋগবেদের প্রধান ত্রিদেব ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যমের
স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন অনার্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু,শিব ও মহেশ্বর। পাওয়া যায় মাতৃরূপিনী আদ্যাশক্তি
মহামায়ার উপাসনার কথাও।এই সাংস্কৃতিক
আদান প্রদানের একটা পর্বে রচিত হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারতের মতো দু’খানি মহাকাব্য। মনে রাখতে হবে এই দুই কাব্য কিন্তু ধর্মগ্রন্থ নয়। ধারনা করা হয়ে থাকে
যে খ্রীস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে রামায়ণএবং মহাভারত শ্রুতিবদ্ধ হয়।
বর্তমানে এই সমস্ত মহান ধর্ম গ্রন্থগুলোর লিখিত রূপ হয়েছে। এই রামায়ণ এবং
মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে ধর্ম এবং যুদ্ধেরকাহিনী। এছারাও পুরাণ নামে যে
ধর্মগ্রন্থগুলো রয়েছে তাতে দেবতাদের এবং
অসুরদের যুদ্ধ নিয়ে ঘটনা আছে।
No comments:
Post a Comment