পরিবর্তিত সমাজ-পরিসরে নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে নিজেেক
পরিচিত করতে এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকুরি বাজারে টিকিয়ে রাখতে আধুনিক শিক্ষা ও
ব্যবস্থাপনা-কৌশলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এছাড়া
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণেও বদলে গেছে এবং যাচ্ছে অধ্যয়ন ও পাঠদানের কৌশলাদি।
কানাডা, আমেরিকা ও ইউরোপের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ওপর বর্তমানে বেশ গুরুত্ব আরোপ করা
হচ্ছে। সেসব দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই কার্যক্রমে অর্জন করেছে পৃথিবীজোড়া
খ্যাতি।
সাধারণভাবে আমরা মনে করে থাকি ক্লাসরুমে পাঠদানের মধ্যেই
শ্রেণী কার্যক্রমের ব্যাপারাদি সীমাবদ্ধ। প্রকৃতঅর্থে একজন শিক্ষক ক্লাসের বাইরেও
পাঠদানে নিজেকে তৈরি করার কাজে চেতনে-অবচেতনে নিয়োজিত থাকেন। কাজেই শিক্ষক যখন পথে
বা পার্কে হাঁটছেন,
গাড়িতে চেপে ভ্রমণ করছেন, কোনো পরিজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে
পারিবারিক আলাপ করছেন কিংবা সমুদ্র বা পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, তখনও
তিনি নানান ফাঁকে নিজেকে ক্লাসরুমে উপস্থাপনের জন্য তৈরি করে চলেছেন নীরবে। অতএব, শিক্ষাদানের
উপাদান ও উপাত্ত সংগ্রহ করা, লেকচার প্ল্যান সাজিয়ে তোলা, শিক্ষার্থীর মনোযোগ সৃষ্টি বা
বৃদ্ধির জন্য কলা-কৌশল আয়ত্ত করা, শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কুশলাদি সম্বন্ধে অবগত
হওয়া, তাদেরকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা, প্রশ্ন সম্বন্ধে কোনো সংশয়ের
মধ্যে না রেখে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করা, পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে
নিষ্ঠার পরিচয় প্রদান,
শিক্ষার মান-উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা
এমনকি সামাজিকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আদর্শ নাগরিক হিশেবে নির্মাণ (প্রয়োজনে
বিনির্মাণও বটে) করার জন্য দরকারি তদারকি করাও একজন শিক্ষকের স্বাভাবিক দায়িত্ব।
ক্লাসরুমে শিক্ষকের
দায়িত্ব হচ্ছে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, শিক্ষার্থীদের
পাঠের সকল বিষয়াদি ম্যানেজ করা এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি, ভালো
ফলাফলের (কেবল কেতাবি অর্থে পরীক্ষার ফলাফল নয়; সামাজিক অর্জন অর্থে শব্দটি
প্রয়োগ করার রীতি চালু রয়েছে) জন্য শিক্ষার্থীর সাইকোলজি স্টাডি করে তার
আগ্রহের-অনাগ্রহের বিষয়ের দিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রদান
করতে হবে।
শ্রেণী ব্যবস্থাপনা
১- শিক্ষক নিজের জন্য একটি স্পষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করবেন
যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি কাজ করে যাবেন।
২- তিনি যা করতে যাচ্ছেন তার স্পষ্টাকারে বর্ণনা দেবেন। কোন
ধরনের অস্পষ্টতা যেন তার লেকচারের ভিতর না থাকে সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ ও খেয়াল
রাখা। সেই সাথে নিজের গলার স্বরকে ভরাট
এবং উচ্চ করতে হবে যাতে করে বড় শ্রেণীকক্ষের ভিতর উপস্থিত কোন শিক্ষার্থী পিছনে
বসেও সবকিছু শুনতে পায়।
৩- তিনি মনোযোগসহ ছাত্রদের প্রশ্ন শুনবেন এবং সে অনুযায়ী
উত্তর প্রদান করতে চেষ্টা করবেন।
৪- তিনি সজাগ দৃষ্টির অধিকারি হবেন।
৫- ছাত্রদের মাঝে সামাজিক ও বৈষয়িক পার্থক্যসমূহ দূরীভূত
করার জন্য উৎসাহী হবেন।
৬- শিক্ষক তার অভিমত ও রায় বস্তুনিষ্ঠ দলিল-প্রমাণের
ভিত্তিতে দাঁড় করাবেন।দলিল-প্রমাণ বিবর্জিত পূর্বনির্ধারিত যে-কোনো সিদ্ধান্ত থেকে
বিরত থাকবেন। যে বিষয়টি অপরিচিত তা
অভিজ্ঞতার আলোকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে।
৭- শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে এমনসব প্রশ্ন করবেন যার দ্বারা
ছাত্রদের চিন্তাশক্তি শানিত হয়, তাদের উদ্ভাবন ক্ষমতা বাড়ে।
৮- যে বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে
বুঝিয়ে দেয়া এবং ছাত্রদেরকে বোঝার জন্য সার্বিক সহায়তা দান।প্রয়োজন হলে তা
পুনরাবৃত্তি করতে হবে এক্ষেত্রে তাকে ধৈর্য্যশীলতা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে।
৯- আলোচনা-পর্যালোচনা, পাঠদান সুনির্দিষ্ট একটি বিষয়ে
সীমিত রাখবেন। বিক্ষিপ্ত হবেন না।
১০- শেখা ও জ্ঞান লাভের প্রতি ছাত্রদেরকে আগ্রহী করে
তুলবেন।
১১- যেসব তথ্য ছাত্রদের জানা প্রয়োজন বা ছাত্ররা যেসব তথ্য
জানতে আগ্রহী সেগুলো তিনি সরবরাহ করবেন।প্রয়োজনে আধুনিক প্রযুক্তি তথা কম্পিউটার,ল্যাপটপ, প্রজেক্টর
ইত্যাদি সরঞ্জামাদির সাহায্যে পাঠদানকে হৃদ্বয়গ্রাহী করে তোলা।
১২- ছাত্রদেরকে বিচারের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার আশ্রয়
নেবেন। ব্যক্তিগত রায় অথবা স্বেচ্ছাচারিতা বর্জন করবেন।
১৩. ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাপারে চাপ না দেওয়া।কারণ পড়াশোনা
করা একজন ছাত্রের নিজস্ব বিষয়। যদি সেখানে অহেতুক চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে সে
পড়াশোনা করার মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারি।তাই তাকে হিকমতের সাথে পড়াশোনার ব্যাপারে
হৃদ্বয়গ্রাহী করে তুলতে হবে।
১৩. পাঠপ্রস্তুতি করতে হবে। অর্থাৎ একজন শিক্ষক যে বিষয়টি
পড়াতে যাচ্ছেন তা ক্লাসে ঢোকার পূর্বে অধ্যায়ন করে ভালো করে বুঝে নেয়া, কঠিন
এবারতগুলোর অর্থ উদ্ধার করে নেয়া। এবং নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ব্যাখ্যায় কি কি
পয়েন্ট উপস্থাপন করা যায় তা আয়ত্ত করে নেয়া। সে হিসেবে পাঠপ্রস্তুতি পর্বে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে-
১৪. পাঠপরিকল্পনা: পাঠপরিকল্পনা লিপিবদ্ধ আকারে হতে হবে। সে
হিসেবে শিক্ষকের জন্য নোটবুক মেইনটেইন করা জরুরি। প্রতিটি দরসের জন্য আলাদা আলাদা
পাঠপরিকল্পনা রচনা করা বাঞ্ছনীয়। পাঠপরিকল্পনায় যেসব পয়েন্ট থাকতে হবে তা হল:
১৫. প্রতিটি দরসের পরিসর নির্ণয়: অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষের প্লান
অনুযায়ী আজকে কতটুকু সবক পড়াতে হবে তা
সুনিদিষ্টভাবে নির্ণয় করে নেয়া। পরীক্ষা আসার পূর্বেই যাতে
পরিকল্পিত পুরো সিলেবাস ভাল করে পড়িয়ে শেষ করা
যায় তা নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়টি খুবই জরুরি। বছরের
শুরুতে ছাত্রও বোঝে শিক্ষকও বোঝেন, মাঝখানে
শিক্ষক বোঝেন ছাত্র বোঝে না, আর শেষে ছাত্র শিক্ষক কেউ বোঝে না, এই বিপদ
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
বিষয়টি খুবই জরুরি।
১৬. প্রতিটি দরসের উদ্দেশ্য নির্ণয় : অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট
অধ্যায় বা সবক পড়ানোর পড় ছাত্ররা কি কি শিখতে সক্ষম হবে। তা স্পষ্টাকারে নির্ণয়
করে নিতে হবে। যেমন অজু বিষয়ক দরসের উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা যেতে পাড়ে - এ দরসের পর
ছাত্ররা অজুর গুরুত্ব,
কুরআন-সুন্নায় অজুর
দলিল, অজুর ফরজ-সুন্নাত-মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয় শিখতে সক্ষম হবে। উদ্দেশ্য নির্ণয়
করে নিলে পাঠদানের পর প্রশ্ন করে ছাত্রদের অর্জন মেপে দেখা সম্ভব হয়। কারও কারও
কাছে বিষয়টি তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বসহ দেখে।
১৭. পাঠদান পদ্ধতি নির্ণয় করে নেয়া: যেমন শিক্ষক ক্লাসে
ঢোকে প্রথমে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে নেবেন আজকের দরসে
ছাত্ররা কি কি শিখবে। এরপর হয়ত কোনো ছাত্রকে এবারত পড়তে
বলবেন। এবারতের মূল বক্তব্য সহজ ভাষায়
বুঝিয়ে দেবেন। কঠিন শব্দ বা বাক্যগুলো বিশ্লেষণ করে
বোঝাবেন। এরপর হয়ত কোনো ছাত্রকে দরসের মূল
পয়েন্টগুলো উল্লেখ করতে বলবেন। অথবা কোনো ছাত্রকে পুরো দরস
সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে বলবেন। আধুনিক
শিক্ষাসরঞ্জাম ব্যবহৃত হলে- যেমন কম্পিউটার, প্রজেক্টার
ইত্যাদি - তা দরসের কোন পর্যায়ে ব্যবহৃত হবে তা নির্ণয়
করে নেয়া। পাঠদান শেষে সুনির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টের উপর
প্রশ্ন করে ছাত্রদেরকে লিখতে বলা হবে কি-না তা নির্ণয়
করে নেয়া।
১৮. সঠিক শুরু - ক্লাস শুরুর প্রথম ৫ মিনিট খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে ছাত্রদের সচেতনতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। তাই এ সময়টুকু
যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক
ক্লাসে প্রবেশের পূর্বেই যেন ছাত্ররা প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকে, ক্লাসে
ঢোকার সাথে সাথে যেন কলম চোখানো, কেতাব বা খাতার পাতা উল্টানো, ব্যাগ থেকে কিতাবপত্র বের করা
ইত্যাদি কর্ম বন্ধ হয়ে যায় এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।
ক্লাসে প্রবেশের পর লিখিত প্লান অনুযায়ী শিক্ষক অগ্রসর
হবেন। প্লান থেকে বিচ্যুত হবেন না। ক্লাসে প্রবেশ করে ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করুন। মুহূর্তকাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও এ কাজটি সম্পন্ন হতে পারে।
১৯. পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে পুরো ক্লাসের প্রতি তাকাতে।
২০. ক্লাসের সকল ছাত্রের প্রতি নজর বুলানো। পুরো ক্লাস
আপনার নখদর্পনে ছাত্রদেরকে এই অনুভূতি দি্তে হবে।
২১. বাড়ির কাজ দিতে হবে নিয়মিত এবং তা দেয়া থাকলে তা সংগ্রহ
করুন।
২২. খুবই উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পাঠদান শুরু করুন।
২৩. ধীরে ধীরে এগিয়ে চলুন। ছাত্ররা যা জানে তা দিয়ে শুরু
করুন।
২৪. বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলুন। আঞ্চলিকতার টানকে পরিহার করে
চলা। বর্ণনাভঙ্গিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। এখানে
অস্পষ্টতা বলতে কিছুই থাকবে না। পাঠদানের বিষয়বস্তুকে
হৃদ্বয়গ্রাহী করে তুলতে হবে।
২৫. ক্লাসে কখনোই দেরি করে প্রবেশ করবেন না। হঠাৎ করে ক্লাসে
ঢুকবেন না। আপনি ক্লাসে আসতে যাচ্ছেন এ
বিষয়ে ছাত্রদেরকে জানান দিন, যাতে তারা প্রস্তুত হয়ে নীরবতা
বজায় রেখে বসে থাকে।
২৬. নির্দিষ্ট কোনো ছাত্র বা পুরো ক্লাসকে বকা-ঝকা দিয়ে
ক্লাস শুরু করবেন না।
২৭. পরিপাটি ও গোছানো আকারে নিজেকে উপস্থাপন করুন।
২৮. প্রতিটি ছাত্রই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারি।
যোগ্যতায়, বোঝার ক্ষমতায় একজন অন্যজন থেকে আলাদা। সে হিসেবে আলাদাভাবে প্রতিটি ছাত্রদের
যোগ্যতা, গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি আয়ত্তে আনা জরুরি। কেননা শিক্ষকের উচিত প্রতিটি ছাত্রকেই
সাহায্য করা। প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে আবিষ্কার না করলে এ দায়িত্ব সঠিকভাবে
পালন করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে যা জানতে হবে তা হল ছাত্রের পড়া-লেখার
বেকগ্রাউন্ড, মেধাকেন্দ্রিক পর্যায়,
ছাত্রের গুরুত্বের বিষয় কি কি।যারা অত্যাধিক মেধাবী তাদেরকে
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগেতে হবে। অপরদিকে
যারা দূর্বল তাদেরকে আলাদাভাবে বিন্যস্ত করে তাদের ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ
গ্রহণ করতে হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে হবে যা হলঃ
১. অধিক মেধাবী
২. মধ্যম মেধাবী
৩. তীক্ষ্মমেধাসম্পন্ন পশ্চাৎপদ
৪. দুরন্ত
২৯. শিক্ষার্থীদের নিজের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে
তোলা
বই পড়া যদি ছাত্রের নেশা হয়ে থাকে তবে সর্বশেষ কোন বইটি সে
পড়েছে তা জিজ্ঞাস করা। ডাকটিকিট সংগ্রহ করার অভ্যাস থেকে থাকলে জিজ্ঞাসা করা যেতে
পারে সর্বশেষ ডাক টিকিট কোনটি। অসুস্থ হলে ছাত্রের স্বাস্থ্য বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ
করা। এরূপ করতে পারলে ছাত্ররা শিক্ষক মহোদয়কে আপন বলে ভাববে। সে নিজেকে ক্লাসের
একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে জ্ঞান করবে। এ সব তথ্য ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের মাঝে
সেতুবন্ধের কাজ করে।
৩০. ছাত্রদেরকে চিনে নেয়া:ছাত্রদেরকে আলাদা আলাদাভাবে চিনে
নেয়া সফল শিক্ষকতার ক্ষেত্রে একটি জরুরি বিষয়। এই কারণে শিক্ষক তার সকল ছাত্রের
নাম মনে রাখার চেষ্টা করবে। প্রত্যেককে নাম ধরে ডাকবে। প্রত্যেক ছাত্রকে প্রতিদিন
একই জায়গায় বসতে বললে,
যে ছাত্রের নাম মনে থাকে না, হাজিরা নেয়ার সময় তার সাথে কথা
বললে ছাত্রদের নাম মনে রাখাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ক্লাস ছোট হলে প্রত্যেক ছাত্রকে
তার নাম লিখে টেবিলের উপর রেখে দেওয়ার
নির্দেশ দেয়া যেতে পারে,
বিশেষ করে ক্লাস চলাকালীন সময়ে। ছাত্রের নাম মনে রাখার
ক্ষেত্রে এটি একটি সহজ পদ্ধতি।
৩১. ক্লাস নিয়ন্ত্রণ - ক্লাস নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় যা হেকমত ও দূরদর্শিতা দাবি করে। ক্লাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষককে অবশ্যই
কঠোর হতে হবে। বিনম্র স্বভাব ছাত্রের কাছে শিক্ষককে প্রিয় করে তুলবে অতঃপর শিক্ষার
উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে, এ ধারণা ভুল। গবেষণা থেকে দেখা
গেছে কঠিন প্রকৃতির শিক্ষককেই ছাত্ররা অধিক সম্মান করে থাকে । বিনম্র-আচরণ-প্রকাশক
শিক্ষক ক্লাসে তার সম্মান-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলতে পারেন; কেননা
বিনম্র স্বভাবকে ছাত্ররা দুর্বলতা বলে ভাবে। সে জন্য শুরুটা হতে হবে কঠোরতা প্রয়োগ করে। তবে ছাত্রদের প্রতি
যেন কোনো জূলুম-অন্যায় অথবা সীমালঙ্ঘন না হয় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে
হবে।পরবর্তীতে সময় সুযোগ বুঝে ছাত্রদের প্রতি এহসান ও বিনম্র আচরণ করে ভারসাম্য
রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
৩২. ক্লাসের ছাত্রদের সাথে গভীর সম্পর্ক --যার আওতায়
শিক্ষকের সম্মান মর্যাদা যথার্থরূপে বজায় থাকে -- কায়েম করা হঠাৎ করে ঘটে-যাওয়া
কোনো বিষয় নয়। তা বরং দাবি করে দীর্ঘ মেহনত-প্রচেষ্টার। পড়ানোর ক্ষেত্রে, উত্তম
আদর্শ হওয়ার ক্ষেত্রে আপনি
ঐকান্তিক-মুখলেস এ বিষয়টি ছাত্রদের কাছে প্রমাণিত হওয়ার পর ছাত্ররা
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আপনাকে সম্মান করবে, ফলে আপনার জন্য ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
ক্লাস নিয়ন্ত্রণের আরেকটি সহায়ক পদ্ধতি হল, ক্লাসে
সম্পন্ন করতে হবে,
এমন কাজ দিয়ে ছাত্রদেরকে ব্যস্ত রাখা। ব্যস্ত রাখতে পারলে ছাত্ররা হৈ-চৈ করার সুযোগ পায় না। সে হিসেবে শিক্ষকের
উচিত হবে পাঠপরিকল্পনায় এমন কিছু বিষয় রাখা যার দ্বারা ছাত্রদেরকে ব্যস্ত রাখা
সম্ভব হবে।
৩৩. উপযুক্ত পরিবেশ গঠন
যেভাবে পাঠদান করলে ছাত্রদের উৎসাহ আগ্রহ বেড়ে যাবে সে ভাবে
পাঠদান করা।এভাবে করে তার শ্রেণীকে পাঠদানের জন্যে উপযুক্ত করে গড়তে তুলতে হবে।
শিক্ষকের একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি সচেষ্ট হবেন, একটি
সুনির্দিষ্ট কর্ম সামনে হাজির রাখতে হবে যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি উৎসাহী
হবেন।মাঝেমধ্যে তার শরীরের বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগকে কাজে লাগিয়ে সকলের কাছে তার
পাঠদানকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সাহায্য করবে। ক্লাসরুমে শিক্ষকের দায়িত্ব হচ্ছে
সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, শিক্ষার্থীদের পাঠের সকল বিষয়াদি
ম্যানেজ করা এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি, ভালো
ফলাফলের (কেবল কেতাবি অর্থে পরীক্ষার ফলাফল নয়; সামাজিক অর্জন অর্থে শব্দটি
প্রয়োগ করার রীতি চালু রয়েছে) জন্য শিক্ষার্থীর সাইকোলজি স্টাডি করে তার
আগ্রহের-অনাগ্রহের বিষয়ের দিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় গাইডলাইন প্রদান
করতে হবে।
৩৪. নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রক্ষা
নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রক্ষা করতে বুঝানো হয় শিক্ষক যেন তার
নিজের পোশাক-পরিচ্ছেদ,চলা-ফেরা,কথা-বার্তা বলার ধরনের ক্ষেত্রে মার্জিত এক ভাব যেন ধরে রাখতে পারে। এরজন্যে
তার পোশাককে হতে হবে পরিচ্ছন্ন। তাকে সকল ধরনের অশালীন কথা-বার্তাকে এড়িয়ে চলতে
হবে।বিড়ি,সিগারেট,পান খাওয়ার মতে বদভ্যাসকে পরিহার করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক যেন
তাদের ভুল-ত্রুটি ধরতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা।
৩৫. অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা
ছাত্র-ছাত্রীর অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত তার অভিভাবকের জানানো
উচিৎ। যদি তার কোন দূর্বলতার দিক লুক্কায়িত থাকে তাহলে তা তাদের কাছে তুলে ধরতে
হবে। কারণ একজন শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক থাকে তার ক্লাস পর্যন্ত কিংবা
যতক্ষণ পর্যন্ত তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকে, কিন্তু সে তার অভিভাবকের সাথে
সর্বদা থাকে। তাই শিক্ষক যদি তাদের দূবল দিকসমূহ অভিভাকদের জানাতে পারে তাহলে
সেক্ষেত্রে অভিভাবকগণ এ ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
৩৬. সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত- শিক্ষক যে শ্রেণীকক্ষে
শিক্ষার্থীদের পাঠদান করবেন সেখানকার পরিবেশকে সুন্দর ও সাবলীল করতে হবে।
শ্রেণীকক্ষে যেন সকল ছাত্র ঠিক মত বসতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে এরপর শ্রেণীকক্ষে
পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে হবে যাতে করে স্বাচ্ছন্দের সাথে তারা
ক্লাস করতে পারে। সেই সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দক্ষিণমুখী করা একান্ত বাঞ্ছণীয়।
লিখিতভাবে ভাষাপ্রয়োগে সঠিক বানান এবং মৌখিক ভাষাপ্রয়োগে
শুদ্ধ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। আদর্শ শিক্ষককে
অনুসরণ করে শিক্ষার্থীরা,
তাই তাকে অবশ্যই ভাষার যথাযথ প্রয়োগের দিকে আন্তরিক দৃষ্টি
প্রসারিত রাখতে হবে। আধুনিক বানান ও উচ্চারণরীতি (বাংলা, ইংরেজি, আরবি
প্রভৃতি) সম্বন্ধে জানতে হলে হালনাগাদ অভিধানের সাহায্য নিতে হবে। নিজে যেমন
অভিধান ও পরিবর্তিত ধারণা সম্বন্ধে অবগত হবেন, তেমনই শিক্ষার্থীদেরকেও এই কাজে
অভ্যস্ত করে তুলবেন।
শুধু লেখাপড়া করলেই গাড়িঘোড়ায় চড়া যায় – এমন
ধারণা এখন আর বিশ্বাস করা চলে না। কারণ আর্থিক ও সামাজিক সাফল্যের পথ বর্তমানে
বহুধা বিভক্ত। ছবিআঁকা,
বিতর্ক, বক্তব্য, সঙ্গীত, নৃত্য, খেলাধূলা প্রভৃতি এখন আর শিক্ষাসম্পূরক কার্যক্রম নয়; মূল
শিক্ষার পরিসরে প্রবেশ করেছে ললিতকলা ও ক্রীড়ার এইসব চর্চা। দেয়ালিকা সম্পাদনা, বিদ্যাপীঠের
বার্ষিকী প্রকাশ,
অ্যালবাম প্রকাশ, বিশেষ বিশেষ প্রকাশনা, সমাজকল্যাণমূলক
কাজে সম্পৃক্ত হওয়া ইত্যাদি কাজে শিক্ষার্থীদেরকে মূল উৎসাহ দিয়ে থাকেন শিক্ষক।
শ্রেণীকক্ষে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আনন্দের দিক ও প্রবণতা
আবিষ্কার করবেন এবং তাকে সাফল্যের পথে পরিচালিত করবেন শিক্ষক। আবার, শিক্ষাসফর
কিংবা পিকনিক আয়োজনের মধ্য দিয়েও শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মনন তৈরিতে সহায়তা করা
সম্ভব।
তথ্য ও সংবাদ জানা এখন আর ফ্যাশন নয়; প্রাত্যহিক
প্রয়োজন। যিনি শেখাবেন,
যারা শিখবে সকলকেই প্রতিদিনের আঞ্চলিক, জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক খবর ও আনুষঙ্গিক তথ্য জানতে হবে। নিজেকে স্মার্ট, অভিজ্ঞ ও
যোগ্য মানুষ হিশেবে গড়তে গেলে প্রতিমুহূর্তের খবরাখবরের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার
অভ্যাস তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি ভূগোল ও পরিবেশ, বিজ্ঞানের অভিযাত্রা এবং চিন্তার
বিবর্তন বিষয়ে শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে।