২য় বিশ্ব যুদ্বের পর পর ইতিহাস যেই যুদ্বটি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত
হয় তা হল ইরাক-ইরান যুদ্ব। মুসলিম উম্মাহের ভিতর ঐক্যের ফাটল সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পশ্চিমা
বিশ্ব যেকয়টি যুদ্বতে উস্কানী প্রদান করে তার ভিতর এটি অন্যতম। এ দুটি দেশ হল তেল সমৃদ্ব
দেশ।দীর্ঘদিন যাবৎ এই দুটি দেশের ভিতর রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামরিক,সীমান্ত,প্রতিযোগিতামূলক
বিরোধ কাজ করতে থাকে যার ফলে ১৯৮০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাদের ভিতর চূড়ান্তভাবে যুদ্ব
সঙ্ঘটিত হয় শাতিল আরবকে কেন্দ্র করে। এ যুদ্বে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্বের
কারণ,ঘটনা এবং ফলাফল নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
যুদ্ব সঙ্ঘটিত হওয়ার কারণসমূহ
১. ঐতিহাসিক কারণঃ ইরাক ও ইরান পাশাপাশি অবস্থান করলেও তাদের ভিতর বিভিন্ন
কারণে দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়।তা হোল
ক. শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বঃ ইরানের অধিবাসীরা বেশিরভাগ শিয়া আর ইরাকে শাসনে
ছিল সুন্নীগণ।এ কারণে তাদের ভিতর সংঘাত কাজ কোর্ট।
খ. আরব-অনারব দ্বন্দ্বঃ এ দ্বন্দ্ব তাদের ভিতর প্রায় ২৫০০ বছর ধরে চলতে
থাকে।
২. রাজনৈতিক কারণঃ বেশকিছু রাজনৈতিক কারণে ইরাক-ইরান যুদ্ব অনিবার্য
হয়ে পড়ে।সেসকল কারণসমূহ নিম্নরূপঃ
ক.শাতিল আরব বিষয়ক চুক্তিসমূহ বাতিলঃ ১৮৪৭ সালে এরিজমার চুক্তি, ১৯১৩,
১৯৩৭ এবং ১৯৭৫ সালে শাতিল আরবকে কেন্দ্র করে যেসকল চুক্তি সম্পাদিত হয় তা অনেকটা অস্পষ্ট
ছিল তা পরবর্তীতে নবায়ন করা অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়। সেসকল চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে,
যেকোন সময় ঐ জলসীমার মোহনায় দ্বীপ গড়ে উঠতে পারে।কিন্তু সেখানে দ্বীপ হলে তার মালিকানা
কীভাবে করা হবে তা নিয়ে কিছুই ঐ চুক্তিসমূহে উল্লেখ করা হয় নাই।
খ. দ্বীপ নিয়ে সঙ্ঘাতঃ ১৯৩৭ সালের দিকে শাতিল আরবের মোহনায় যেসকল দ্বীপ
জন্ম নেয় তার অধিকাংশ দ্বীপ ইরান দখল করে নেয় যার ফলে তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ
আরও বৃদ্বি পেতে থাকে।
গ.ইরাকের শক্তিশালী হওয়ার ইচ্ছাঃ ইরাক অনেক আগে থেকে সারা বিশ্বের কাছে
একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে থাকে যার ফলে ইরাক
ইরান আক্রমণ করে এবং যুদ্ব শুরু হয়।
ঘ.কুর্দীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগঃ ইরাকের সাদ্দাম সরকার ইরানের বিরুদ্বে
এই অভিযোগ আনায়ন করে যে, তার দেশের বিদ্রোহী তথা কুর্দী এবং শিয়াদের ইরান সরকার বিশেষভাবে
সহায়তা প্রদান করছে। সাদ্দাম সরকার অসংখ্য শিয়া এবং কুর্দীদের ইরাক থেকে বহিস্কার করে
তারা ইরানের শরনার্থী হিসেবে ইরানে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদের ভিতর উত্তজনা প্রবলভাবে
বৃদ্বি পায়।
ঙ. খোমেনীকে বহিস্কারঃ ইরাক সরকার ১৯৭৮ সালে ইমাম খোমেনীকে ইরান থেকে
বহিস্কার করে এরপর যখন খোমেনী ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন থেকে তাদের ভিতর সম্পর্কের
তিক্ততা সৃষ্টি হয়।
ঙ.একে অপরের প্রতি অপপ্রচারঃ একদিকে সাদ্দাম হুসেইন ইরানে খোমেনীকে ধর্মান্ধ
ও উগ্র মৌল্বাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে অন্যদিকে খোমেনী সরকার সাদ্দাম সরকারকে কাফির এবং
নাস্তিক হিসবে অভিহিত করতে থাকে
চ. সীমানা লঙ্ঘনঃ এই দুই দেশের ভিতর দীর্ঘদিন যাবৎ সীমানাগত দ্বন্দ্ব
পরিলক্ষিত হয়। ইরাকের বিরুদ্বে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের সীমান্তে আক্রমণ করার
অভিযোগ করা হয় যা দুই দেশের ভিতর যুদ্ব শুরু করতে তরন্বিত করে।
ছ. ইরাকের আণবিক শক্তি অর্জনঃ ইরাক আণবিক শক্তি অর্জনের ব্যাপারে কাজ
শুরু করে।১৯৭৯ সালে ইরাকী নেতা তারেক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ঘোষণা প্রদান করেন যে, “আণবিন শক্তি অর্জনে
ইরাক কোন বাধা মানবে না।” ইরাকের এই ঘোষণা অতি সহজে ইরান মেনে নেয়
নাই এবং তাদের বিরোধ বৃদ্বি পায়।
জ. বাহরাইন সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষে ইরাকের অবস্থানঃ ১৯৬৮ সালে ইরান
বাহরাইনের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে আবার ১৯৭১ সালে নভেম্বর মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের
আবূ মূসা দ্বীপটি ইরান দখল করে নেয়।এমন সময় সাদ্দাম সরকার ইরানের বিরুদ্বে অবস্থান
নেয়।
ঝ. ইরাকে ইসলামী শক্তি ও গণতন্ত্র দমনঃ ইরানে আকস্মিকভাবে ইসলামী বিপ্লব
এবং তাৎক্ষণিক গণতন্ত্রের উদ্ভবের ফলে ইরাকের স্বৈর বাম শাসক সাদ্দাম হুসেইন শঙ্কিত
হয়ে পড়েন।তা যেন ইরাকের জনগণের ভিতর না ছড়াতে পারে এ লক্ষ্যে তিনি যুদ্বে অবতীর্ণ হন।
ঞ. খুজিস্তানকে ইরাকের অন্তর্ভূক্তিঃ ১৯২৫ সালে ইরান খুজিস্তান দখল করে
নেয় এবং সেখনকার লোকেরা ছিলেন আরব।কিন্তু ইরানী সরকার তাদের উপর ফার্সী ভাষাকে জোড়পূর্বক
চাপিয়ে দেয়। তাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে এবং এর ফলে সাদ্দাম হুসেইন তাদেরকে বিশেষভানে
সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে সাহায্য করে এবং ইরানের সাথে বিরোধ বৃদ্বি পায়।
৩. অর্থনৈতিক কারণঃ শাতীল আরব ছিল ইরাকের জন্য একটি মূল অর্থনৈতিক শক্তির
চাবি-কাঠি।এরই মাধ্যমে ইরাকের অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হত।ইরাকের তেল আমদানী-রপ্তানী
হত এই বন্দরের মাধ্যমে।কিন্তু এখান ইরান প্রাধান্য বিস্তার করাতে তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন
হয় এবং ইরাক সরকার তা দখলের ব্যাপারে বদ্বপরিকর হয়।
৪. সাংস্কৃতিক কারণঃ ১৯২৫ সালে ইরান খুজিস্তান দখল করে নেয় এবং সেখনকার
লোকেরা ছিলেন আরব।কিন্তু ইরানী সরকার তাদের উপর ফার্সী ভাষাকে জোড়পূর্বক চাপিয়ে দেয়।
তাদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে এবং এর ফলে সাদ্দাম হুসেইন তাদেরকে বিশেষভানে সাহায্য
ও সহযোগিতা দিয়ে সাহায্য করে এবং ইরানের সাথে বিরোধ বৃদ্বি পায়।
৫. বৈদেশিক কারণঃ ইরানে ইসলামী বিপ্লব সঙ্ঘটিত হওয়ার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাথে তাদের এক গভীর বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল।কিন্তু তা ইসলামী বিপ্লবের পর তাদের সম্পর্কোবনতি
ঘটতে থাকে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরান সরকারকে পছন্দ করতে পারে নাই।একদিকে ইরাক
মিসরের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে আবার অন্যদিকে ইরান পাকিস্তান তুরস্ক এবং পাকিস্তানের
সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে যার ফলে দুই দেশের ভিতর বৈরীতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয় এবং মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের উস্কানীর ফলে ইরাক-ইরান যুদ্ব সঙ্ঘটিত হয়।
যুদ্বের অবস্থা
১৯৮০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইরাকের সাদ্দাম বাহিনী সর্বপ্রথম ইরানের বিমান
ঘাটিতে হামলা পরিচালনা শুরু করে।এতে করে ইরানী বেশ কিছু জেট বিমান ধংসব সাধিত হয়।১৯৮৩
সালে ইরান ইরাকের বসরা ও ফাও দ্বীপ দখল করে নেয়।কিন্তু এখানে তারা খুব বেশী একটা সুবিধা
করতে পারে নাই বলে পরে তারা চলে চায়।১৯৮৪ সালে ইরাক ইরানের ট্যাঙ্কারের উপর হামলা চালায়।
ইতমধ্যে ইরাকের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে যায়। তখন ইরাক ইরানের সাথে সমঝোতা করার জন্য
আহবান জানালে ইরান তা সরাসরি প্রত্যাখান করে এবং ইরান তখন হুশিয়ারী করে দেয় যে, সাদ্দামকে
উৎখাত না করা পর্যন্ত,তাদেরকে ১৬০ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত এবং ইরাকী সৈন্য
সেখান থেকে প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত কোন সমঝোতায় তারা পৌছবে না।এর ফলে ১৯৮৭ সালে
ইরানী হাজীগণ মক্কায় বিক্ষোভ করলে সেখানে সৌদি
পুলিশ তাদের উপর গুলি বর্ষণ করে।এতে করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমর্থন ইরান হারাতে থাকে।তারপর
১৯৮৮ সালের ৩ জুলাই ইউ.এস.এ কর্তৃক ইরানের ২৯০ জন যাত্রীবাহী একটি বিমান ভূপাতিত করা
হলে ইরান একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর ১৮ই জুলাই,১৯৮৮ সালে ইমাম খোমেনী যুদ্ব বিরতির
চুক্তি মেনে নেয়।এই সুযোগে ইরাক ইরানের বেশ কিছু জায়গা পুনর্দখল করে নেয়।১৯৮৮ সালের
২০ আগষ্ট যুদ্ব বিরতি কার্যকর হয়।২১ জানুয়ারি, ২০০২ সালে তাদের ভিতর বন্দী বিনিময় চুক্তি
যার ফলে ইরাক থেকে ৬০০ ইরানী এবং ইরান থেকে ১১০০ ইরাকী মুক্তি পায়।
ইরানের সৈন্যবাহিনীঃ ৩০৫,০০০ সৈন্য, ৯০০ ট্যাংক, ১০০০ সাঁজোয়াযান, ১০০০
আর্টিলারি, ৪৪৭ টি যুদ্ধবিমান, ৭৫০ টি হেলিকপ্টার
ইরাকের সৈন্যবাহিনীঃ ১৯০,০০০ সৈন্য, ৫০০০ ট্যাংক, ৪০০০ সাঁজোয়া যান,
৭,৩৩০ আর্টিলারি ইউনিট, ৫০০+ যুদ্ধবিমান, ১০০+ হেলিকপ্টার
সমর্থনঃ ইরাকের পক্ষে সমর্থন দেয় ইউ S S R থেকে সমর্থনের সঙ্গে।, ফ্রান্স,
ব্রাজিল, সৌদি আরব, মিশর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরাকের জন্য এবং অন্যান্য আরব, ন্যাটো
এবং ওয়ারশ Pact দেশগুলো।
ইরানকে সমর্থন করে কেবলমাত্র লিবিয়া, সিরিয়া,আলজেরিয়া এবং পি.এল.ও।
ফলাফল
১. মুসলিম উম্মাহের ভিতর ঐক্যের ফাটলঃ ইরাক-ইরান যুদ্বকে কেন্দ্র করে
এক একটি মুসলিম এক এক এক পক্ষকে সমর্থন দিতে থাকে।যার জন্য মুসলিম উম্মাহের ভিতর ঐক্যের
ফাটল পরিলক্ষিত হয়।
২.জীবনহানীঃ ইরাক ইরানের যুদ্বের ফলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানী ঘটতে
থাকে। এ যুদ্বে দুই দেশের প্রায় ১০ লক্ষ লোক আহত এবং ৫ লক্ষ লোক নিহত হয়।
৩. ইসরাইলের অপতৎপরতা বৃদ্বিঃ ইরাক-ইরান যুদ্বের সময় আরবেরা এই যুদ্ব
নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে ইসরাইল এই সুযোগে প্যালেষ্টাইন,তিউনিশিয়া এবং লেবাননের উপর হামলা
চালিয়ে বহু নীরহ লোক তারা হত্যা করে।
৪. আরব জাহান দ্বিধাবিভক্তিঃ এই যুদ্বকে কেন্দ্র করে সমগ্র আরব বিশ্ব
দ্বিধাবিভক্তি হয়ে পড়ে যার জন্য আরবদের ভিতর ঐক্যের ফাটল পরিলক্ষিত হয়।
৫. মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপাত্য প্রতিষ্ঠাঃ এই যুদ্বের
ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন আধিপাত্যের সংখ্যা বৃদ্বি পেতে থাকে। আরব সরকারগুলো মার্কিন
নীতির দ্বারা পুতুল সরকারে পরিণত হতে থাকে।
৬. ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়-ক্ষতিঃ এ যুদ্বের দুই পক্ষের ব্যাপক অবকাঠামোগত
ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হতে থাকে। এই যুদ্বের ফলে উভয় দেশের যেই ক্ষয়-ক্ষতি হয় তার উন্নয়নে
তাদের ভিতর অনেক সময় লেগে যায়।
৭. স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার বিপর্যস্ততাঃ যখন কোন একটি অঞ্চলে যুদ্ব বিরাজমান
হয় তখন সেখানে স্বাভাবিকভাবে জীবন-মানের বিপর্যস্ততা সৃষ্টি হয়। সেখানকার লোকদের শিক্ষা,চিকিৎসা,আহার
ইত্যাদি জীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থের শিকার হয়।
৮. অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধনঃ এ যুদ্ব পরিচালনা করতে যেয়ে দুই দেশের প্রচুর
অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয় যা দূর করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
৯. অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্বিঃ এই যুদ্ব সঙ্ঘটিত হওয়ার ফলে বাজারে অস্ত্রের
চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্বি পায়।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, এই যুদ্ব আমাদের সেই আইয়্যামে জাহেলিয়াতের গোত্র-গোত্রভিত্তিক
যুদ্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই যুদ্বের দ্বারা পশ্চিমা বিশ্ব সন্তুষ্ট থাকলেও মুসলিম
উম্মাহের ভিতর ঐক্যের ফাটল নষ্ট হতে থাকে যার ফলে মুসলিম জাতিকে একত্রিত করা একটি দুরুহ
কাজ হয়ে দাড়ায়।
Very good
ReplyDelete