উমাইয়া
বংশের প্রতিষ্ঠাতা আমিরে মুয়াবিয়া
পৃথিবীর
ইতিহাসে যে সকল মনীষী তাদের স্বীয় যোগ্যতার বলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে আমিরে
মুয়াবিয়া হলেন অন্যতম। যিনি শৌর্য, বীর্য,
বীরত্ব, সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
এ সকল অনুপম চরিত্রের সন্নিবেশের সমাবেশ ছিল তার জীবনে।
কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্রে ৬০৬ খৃস্টাব্দে
মুয়াবিয়া জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন
উমাইয়া দলপতি এবং পবিত্র কাবার রক্ষক ইসলামের চরম দুশমন আবু সুফিয়ান।
মাতা হৃদয়হীনা হিন্দা,যিনি ওহুদ যুদ্ধে নিহিত রাসূলের প্রাণের চাচা
আমির হামজার কলিজার ভক্ষণ করে ইসলামের ইতিহাসে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।
৬৩০ খৃস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর
তার পিতা আবু সুফিয়ানের সাথে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ইসলামের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ
করেন আজীবন। এ সমস্ত অসাধারণ
গুণের জন্য রাসূল (সাঃ) তাকে বেশি ভালবাসতেন। যার
ফলে মুয়াবিয়া ওহী লিখবার জন্য রাসূলের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন।
পরে তার ভগ্নি উম্মে হাবিবার সাথে মহানবীর বিবাহ সম্পাদিত হলে উভয়ের
মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়।
ইসলামের
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের খিলাফতকালে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন।
সেই থেকে তার রাজনৈতিক জীবনের পথে হাঁটা শুরু হয়।
কর্মদক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার বলে সমগ্র সিরিয়ার
সুশাসন কায়েম করতে সক্ষম হন ও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
নির্ভীকতা ও সামরিক দক্ষতার সাথে সিরিয়াকে বায়জানটাইন আক্রমন হতে
রক্ষা করতে সমর্থ হন। খলিফা ওসমানের
সময় সর্বপ্রথম একটি ক্ষুদ্র নৌবাহিনী গঠনে করে দীপাঞ্চলে মুসলিম প্রাধান্য বিস্তার
করার চেষ্টা করেন। তারই সুযোগ্য নেতৃত্বে
সাইপ্রাস ও রোডস দ্বীপ দখল করেন। হযরত
ওসমানের হত্যাজনিত গোলযোগ সময় হতে হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়।
পরে হযরত আলীর হত্যা ও পুত্র ইমাম হাসানকে পরাজিত করে সন্ধিচুক্তিতে
স্বাক্ষর করে মুয়াবিয়া খিলাফত লাভ করেন এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা
করেন।
৬৬১ খৃস্টাব্দে ইমাম হাসানকে খিলাফতের ন্যায্য
অধিকার হতে বঞ্চিত করে মুয়াবিয়া ইসলামী সাম্রাজ্য তথা দামেস্কের সিংহাসনে আরোহন করেন
এবং ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।
রাজতন্ত্রের সূচনাও তিনিই করেন।
বিশ্বের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক মূইর বলেন,
‘‘মুয়াবিয়া দামেস্কের সিংহাসনে আরোহন খিলাফতের
সমাপ্তি এবং রাজতন্ত্রের সূচনা করে।’’
তবে
যে পন্থাই অবলম্বন করে থাকুক না কেন, মুয়াবিয়াকে অভিজ্ঞ শাসন, সুনিপুণ কূটনীতিবিদ,
নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে। তিনি
ক্ষমতা লাভ করে কূফা থেকে দামেস্ককে নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানীতে
রূপান্তরিত করেন। যা করা অনেকের
জন্য ছিল অসম্ভব তা তিনি করে দেখিয়েছেন স্বীয় যোগ্যতা আর কূটনীতিক ক্ষমতাবলে।
তবে একটা কথা থেকে যায় যে, তার আশেপাশের লোকদের থেকে তিনি যথেষ্ট
সহযোগিতা পেয়েছিলেন এবং তাদের থেকে কাজও আদায় করতে জানতেন।
সে দৃষ্টিকোণ থেকে আমির মুয়াবিয়া ছিলেন ভাগ্যবান।
চারপাশের
লোকদের সহযোগিতা না পেলে মুয়াবিয়ার একক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক পর্যায়ে উমাইয়াদর সামরিক
ও রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন কঠিনতর ছিল।
ঐতিহাসিক
হিট্টির মতে,
‘‘খলিফা মুয়াবিয়ার সাফল্যের মূলে তার চারিপার্শ্বের
অনুগামীবর্গের অবদানও কম ছিল না, বিশেষ করে মিসরের শাসনকর্তা আমর ইবনুল আস; বিক্ষুব্ধ
কূফার প্রশাসক আল মুগীরা আল সাবাহ। বিদ্রোহী
বসরার শাসনকর্তা জিয়াদ ইবন আবিহ। এই
তিনজন তাদের নেতা মুয়াবিয়াসহ আরব মুসলমানদের চারজন রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি বলে
পরিচিত।’’
মুয়াবিয়ার
শাসনকালে জিয়াদ ইবন আবিহ অশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। জিয়াদ
ছিলেন মুয়াবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ানের জারজ সন্তান। তার
মাতা ছিলেন তায়েফের একজন ভ্রষ্টা রমনী ও আবু সুফিয়ানের উপপত্নী।
কিন্তু আশ্চযের বিষয় হল, জন্ম নীচ পরিবেশ হলেও দক্ষতা ও অধ্যবসায়ের
গুণে তিনি মুসলিম ইতিহাসের একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
‘জন্ম হোক যথা তথা
কর্ম হোক ভাল'। এই প্রবাদের সত্যতা
আমরা জিয়াদ ইবন আবিহর মধ্যে দেখতে পাই। তিনি
ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলীর খিলাফতকালে বসরা ও ইসতাখরে শাসনকর্তার মর্যাদালাভ করেন।
বুদ্ধিমত্তা, বাগ্নিতা ও কর্ম প্রতিভার জন্য সে যুগে একজন বিচক্ষণ
রাজনীতিবিদরূপে পরিচিত ছিলেন। মুগারীর
মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া জিয়াদকে একইসঙ্গে বসরা ও কূফার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
একথা
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আমর ইবনুল আসের কূটনৈতিক তৎপরতা ব্যতীত মুয়াবিয়া কিছুতেই
উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। বহুমুখী
প্রতিভার অধিকারী আমর সম্বন্ধ মূইর বলেন,
‘‘খিলাফতের পরিবর্তনের আমরের চেয়ে অপর কেহই
অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে
সাহসী, পরামর্শে ধূর্ত, কথায় ও কাজে রুক্ষ, নীতিজ্ঞানশূণ্য আমরের বুদ্ধি বলেই মুয়াবিয়া
হযরত আলীর উপর বিজয়ী হন এবং পরিণামে উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।’’
মুয়াবিয়ার
রাজ্য বিজয় সম্পর্কে হিট্টি বলেন,
‘‘মুয়াবিয়ার শাসনকালে খিলাফত কেবল সুসংহতই
হয়নি; বরং আঞ্চলিক বিস্তৃতিও সাধিত হয়েছিল।’’
৬৭৯ খৃস্টাব্দে মুয়াবিয়া তদীয় পুত্র ইয়াজিদকে
উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করে খেলাফতে রাশেদার যুগের পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত
করেন। ইয়াজিদকে মনোনীত করার পর মুয়াবিয়া ৬৮০ খৃস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।
মুয়াবিয়া
শঠতার বশবর্তী হয়ে খিলাফত লাভ করলেও তাকে ইসলামের ইতিহাসে একজন অনন্য প্রতিভা ও ব্যক্তিসম্পন্ন
শাসকরূপে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি গৌরবর্ন,
দীর্ঘাকৃতি ও স্থুলকায় দেহের অধিকারী ছিলেন। তার
চরিত্রেও বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী গুণাবলীর সমাবেশ
লক্ষ্য করা যায়। শাসক হিসেবে ধূর্ত,
কপট ও অমিতব্যয়ী হলেও তার ব্যক্তিগত জীবন কলুষিত ছিল না।
ইসলামের সম্প্রসারণে মুয়াবিয়ার অবদান অনস্বীকার্য।
হিট্টি
বলেন,
‘‘যোদ্ধা হিসেবে তিনি হযরত আলীর অপেক্ষা নিকৃষ্ট
হলেও সামরিক সংগঠক হিসেবে তার সসসাময়িকদের মধ্যে অদ্বিতীয় ছিলেন।’’
মুয়াবিয়া
সূক্ষ্ম রাজনীতিক ও সুশাসন হিসেবে অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন।
চারিত্রিক দুর্বলতা এবং বংশীয়পক্ষপাতিত্ব সত্ত্বেও একথা স্বীকার করতে
হবে যে, তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো যে, তিনি ছিলেন,
ধীরস্থির, হিসাবী, মেধাবী ধৈর্য্যশীল ও দূরদর্শী এবং কর্মঠ।
তার অনুসৃত নীতিগুলো বৃহত্তর ইসলামের স্বার্থে প্রয়োগ করা হলে ইসলাম,
রাষ্ট্র ও ধর্ম আরো সুসংসহ এবং শক্তিশালী হতো। কিন্তু
দুর্ভাগ্যক্রমে প্রশাসনিক কাঠামো গঠিত হয়েছিল উমাইয়া বংশের স্বার্থ রক্ষার্থে।
পরিশেষে
একথা বলা যায় যে, এত আলোচনা আর সমালোচনার পর আমির মুয়াবিয়া ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ।
রাসূল (সা) তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
অধিকন্তু তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত সাহাবী।
আর সাহাবীদের সম্বন্ধে তার বেফাঁস মন্তব্য করতে রাসূল (সা) আমাদেরকে
নিষেধ করেছেন। বর্ণাঢ্য জীবনের
অধিকারী আমির মুয়াবিয়ার নাম ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণক্ষরে লিখা থাকবে।
very good writing
ReplyDeleteThanks a lot.
Deletethrough an invitation to ur friend to visit us