বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগের (১২০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)শুরুতে (১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ) সময়কে কোন কোন গবেষকবাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগবলে অভিহিত করে থাকেন। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দ তুর্কী বীরইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। কেউ কেউ মনে করেনএই রাজনৈতিক পরিবর্তন বাংলার শিক্ষা সমাজ এবং সাহিত্যকে ঋণাত্মকভাবেপ্রভাবিত করে, যে কারণে কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয় নি। ১৩৪২খ্রিস্টাব্দেবড়ু চন্ডীদাসরচিতশ্রীকৃষ্ণকীর্তনরচনার আগ পর্যন্ত এ সময়টাই অন্ধকার যুগ। তবে এটি একটি বিতর্কিত অভিধা।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যঃ
বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগে প্রবেশ করলে প্রথম কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
বাংলা সাহিত্যের ২য় গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কোনো একক কবির রচনা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা সাহিত্যের প্রথম কাব্য।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য রচনা করেছেন একজন কবি যার নাম বড়ুনচন্ডীদাস
পক্ষান্তরে চর্যাপদের পদকর্তা ২৪ জন
কবির পরিচয়ঃ
এ কাব্যের কবি হলেন বড়ুন চন্ডীদাস
এট তার ছদ্মনাম বা উপাধি
তার প্রকৃত নাম অনন্ত বড়ুয়া / অনন্ত বড়ু / অনন্ত বড়াই
তিনি যাত্রাপালা / নাট্যপালার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সেকারণে নাটকীয় ভঙ্গিতে তিনি এই কাব্য রচনা করেন।
বড়ুচন্ডীদাসঃ
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে ‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার।৭টি পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়।ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ।কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন।বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী মনসার অপর নাম।
রচনাকালঃ
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে পনের শতাব্দীর শুরুতে রচিত হয়
বিষয়বস্তুঃ
১. এ কাব্যে মোট ১৩টি খন্ড রয়েছে
২. এ কাব্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাঁধা-কৃষ্ণ এর প্রেমলীলা বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপটঃ
এ কাব্যটি রচনার ৫০০ বছর পর আবিষ্কার করা হয়। বর্তমানে কাব্যটির বয়স ৬০০ বছর। ১৯০৯ সালে বসন্ত রঞ্জন রায় যার উপাধী বিদ্বদ্ববল্লভ। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলার কোকিলা গ্রামে এক গৃহস্থলীর গোয়াল ঘরের টিনের চালের নীচ থেকে আবিস্কার করেন।
১৯১৬ সালে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ যা পরে নাম পরিবর্তন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য রাখা হয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের প্রধান চরিত্রঃ
১. রাঁধা ২. কৃষ্ণ ৩. বড়াই
১. রাঁধাঃ এ কাব্যে রাঁধা কেন্দ্রীয় নারী তথা নায়িকা চরিত্রে ঘোষ পরিবারে জন্ম। অপূর্ব সুন্দরী রাঁধার বিয়ে হয় বীরপুরুষ আয়েন ঘোষ / আইহেন ঘোষ এর সাথে। আয়েন ঘোষের গৃহে রাঁধার দেখাশুনার দায়িত্বভার পরে তার পিসিমা বড়াই এর উপর। পৌরাণিক কাহিনী মতে রাঁধা মানবাত্নার প্রতীক। এ কাব্যে রাঁধা রক্তমাংসে গড়া এক নারী যার মনে প্রেম আছে আবার দৈহিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার আকাংখাও আছে।
২. কৃষ্ণঃ এ কাব্যের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র। তার প্রধান গুণ বাঁশীবাদক / বংশীবাদক। তার প্রধান পরিচয় রাঁধার প্রেমিক রূপে। রাঁধা সম্পর্কে কৃষ্ণের প্রতিবেশী মামী ছিলেন। পৌরাণিক কাহিনীমতে কৃষ্ণ হচ্ছে ভগবান / স্রষ্টা / পরমাত্না। কিন্তু এ কাব্যে রক্তমাংসে গড়া এক যুবক।
৩. বড়াইঃ বড়াই এ কাব্যের ৩য় চরিত্র। রাঁধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্ক সৃষ্টিতে বড়াই এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। এজন বড়াইকে রাঁধা-কৃষ্ণের প্রেমের দূতী বলা হয়।
বৈষ্ণপদাবলীঃ
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে একজন মহামানবের আগমন ঘটে তার নাম শ্রীচৈতন্যদেব। তার প্রচারিত ধর্মের নাম বৈষ্ণব ধর্ম। তার জীবন ও তার প্রচারিত ধর্ম মধ্যযুগের একশ্রেণী পদাবলী সাহিত্য রচিত হয় যার নাম বৈষ্ণপদাবলী হিসেবে পরিচিত। বৈষ্ণপদাবলী কে কড়চা নামেও বলা হয়ে থাকে।
বৈষ্ণপদাবলীর আদি কবি – চন্ডীদাস
তার বিখ্যাত বাণী – সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
বৈষ্ণপদাবলীর আরেক কবি জ্ঞানদাস
বিদ্যাপতীঃ
পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি কিন্তু বাঙ্গালী ছিলেন না। আবার বাংলায় কোনও পদ রচনা করেননি। তার অধিকাংশ রচনা সংস্কৃত ও ব্রজবুলি ভাষায় তাকে মিথিলার কোকিল / মৈথিলী কোকিল বলা হয়ে থাকে। তাকে কন্ঠহার নামেও ডাকা হয়।
ব্রজবুলীঃ
এটি একটি ভাষার নাম। এর আক্ষরিক অর্থ ব্রজ অঞ্চলের বুলি / কথা / ভাষা। ব্রজবুলী হচ্ছে এক প্রকার কৃত্রিম মিশ্র ভাষা / কাব্যিক ভাষা। এটি কখনই জনসাধারণের মুখের ভাষা ছিলনা।
তবে রাঁধা কৃষ্ণ এই ভাষায় প্রেমালাপ করতেন [প্রেমের ভাষা সব সময়ই আলাদা হয়]
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে কোনও প্রকার পদ রচনা না করেও পদাবলী সাহিত্যে / মধ্যযুগে / বাংলাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন শ্রীচৈতন্যদেব। তার জীবনকে নিয়েই যুগের সৃষ্টি হয়েছে
১. শ্রীচৈতন্যদেব পূর্ব যুগ (১৪০১-১৫০০)
২. শ্রীচৈতন্যদেব যুগ (১৫০১-১৬০০)
৩. শ্রীচৈতন্যদেব পরবর্তী যুগ (১৬০১-১৭০০)
মঙ্গলকাব্যঃ
মঙ্গল অর্থ শুভ বা কল্যাণ। মধ্যযুগে হিন্দু ধর্মাবল্বী দিবদেবী নির্ভর এক আখ্যান(কাহিনী) কাব্য রচনা করেন যা মঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত। মঙ্গলকাব্যের রচনাকাল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত( প্রায় চারশত বছর)। মঙ্গলকাব্যের নামকরণ হবার কারণ ২টি।
১. এক মঙ্গলবার পাঠ শুরু করে আর এক মঙ্গল বার শেষ করা হতো
২. মঙ্গল কাব্য পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে বা ঘরে রাখলে সকল মঙ্গল সাধিত হত।
মঙ্গলকাব্যের শাখা তিনটি। যথা: ১. মনসামঙ্গল ২. চন্ডীমঙ্গল ৩. ধর্মমঙ্গল।
তিনটি শাখার আদি কবি যথাক্রমে
১. মনসা মঙ্গল – কানা হরি দত্ত।
২. চন্ডীমঙ্গল – আদি কবি- মানিক দত্ত (চর্তুদশ শতক),
প্রধান কবি- মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। উপাধি- “কবি কঙ্কণ”
৩. ধর্মমঙ্গল – ময়ুর ভট্ট।
অন্নদা মঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর। মনসা মঙ্গল কাব্যের অপর নাম-পদ্মপূরাণ (১৪৯৮ খ্রীঃ)। মনসা মঙ্গল কাব্যের কয়েকজন কবির নাম হল- নারায়ণ দেব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজবংশীদাস।বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত মনসামঙ্গল কাব্যের নাম “মনসা বিজয়”। মধ্যযুগের সবচাইতে প্রতিবাদী চরিত্র মনসা মঙ্গল কাব্যের চাঁদ সওদাগর। মনসামঙ্গল কাব্যের ২২ জন ছোট-বড় কবিকে একত্রে বাইশা বলা হয়। মঙ্গল ধারার তথা মধ্যযুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। ভারত চন্দ্রকে “গুণাকর” উপাধি দেন নবদ্বীপ বা নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। “চৈতন্যমঙ্গল” ও “ গোবিন্দ মঙ্গল” কাব্য দুটির শেষে মঙ্গল থাকলেও এগুলো মঙ্গল কাব্য নয় এগুলো বৈষ্ণব সাহিত্যের অংশ। একটি স্বার্থক মঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য ৫ টি।
No comments:
Post a Comment