Saturday, 12 July 2014

প্রশ্নঃ শিক্ষা কি? শিক্ষার পরিধি ও লক্ষ্য কি?


ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রতিশব্দ হলো Education. Education শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ হলো : শিক্ষাদান ও প্রতিপালন, শিক্ষাদান, শিক্ষ। Educate মানে : to bring up and instruct, to teach, to train অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করিয়া তোলা, শিক্ষা দেওয়া, অভ্যাস করানো।[Samsad English-Bengali Dictionary]
Education এর বুৎপত্তিগত অর্থ  হল এই যে, শিক্ষার্থীর ভিতর ঘুমন্ত প্রতিভা বা সম্ভাবনার পরিস্ফুটন। 
Joseph T. Shipley তাঁর Dictionary of word Origins এ লিখেছেন, Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex এবং Ducer-Duc শব্দগুলো থেকে। এ শব্দগুলোর শাব্দিক অর্থ হলো, যথাক্রমে বের করা, পথ প্রদর্শন করা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে দেয়া।[মোহাম্মাদ আজহার আলী : পাঠদান পদ্ধতি ও শ্রেণী সংগঠন, বাংলা একাডেমী-১৯৯৮]
একজন শিক্ষাবিদ লিখেছেন, Education শব্দের বুৎপত্তি অনুযায়ী শিক্ষা হলো শিক্ষার্থীর মধ্যকার ঘুমন্ত প্রতিভা বা সম্ভবনার পথ নির্দেশক।[মোহাম্মাদ আজহার আলী : পাঠদান পদ্ধতি ও শ্রেণী সংগঠন, বাংলা একাডেমী-১৯৯৮]
আরেকজন শিক্ষাবিদ লিখেছেন :
Education denotes the realization of innate human potentialities of individuals through the accumulation of knowledge. [Education in Islamic Society : A. M. Chowdhury : Dhaka 1965]
World Book Encyclopaedia তে বলা হয়েছে,
Education is the process by which people acquire knowledge, skills, habits, values and attitudes. [World Book Encyclopaedia,USA, Vol-4,Page-561]
কবি জন মিল্টন বলেন, Education is the hermonious development of body,mind and soul.
বার্টাড রাসেল বলেন, মানব প্রকৃতি যার উপর তার উপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়। [Bertrand Russel, On Education,p.19]
আল্লামা ইকবাল বলেন,মানুষের রুহের উন্নত করার প্রচেষ্টা হল শিক্ষা।
রবী ঠাকুর বলেন, মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর উন্নতি ও বিকাশের নাম হল শিক্ষা।
সক্রেটিস বলেন, নিজেকে জানার নাম হল শিক্ষা।
মহাত্মা গান্ধী বলেন, মানুষের আগমন যেসকল সদ্গুণাবলীর মাধ্যমে আগমন ঘটে তার বিকাশকে শিক্ষা বলে।
কুরআন হাদীস এবং আরবী ভাষায় শিক্ষার জন্যে যেসব পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, সে শব্দগুলো এবার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি শব্দের ব্যবহার সুবিদিত। সেগুলো হলো : ১. তারবীয়াহ (تربية) ২. তালীম (تعليم) ৩. তাদীব (تأديب) ৪. তাদরীব (تدريب) ৫. তাদরীস (تدريس) ।
এই শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থ নিন্মরূপ :
تربية শব্দটি নির্গত হয়েছে ربو শব্দ থেকে। ربو মানে : Increase, to grow. to grow up, to exceed, to raise, rear, bring up, to educate, to teach, instruct, to bread, to develop, augment.
আর تربية মানে : Education, up bringing Instruction, Pedagogy, Breeding, Raising. [মুজামুল লুগাতুল আরাবিয়াতুল মুআসিরাহ By J. Milton Cowan.]
تعليم শব্দটি গঠিত হয়েছে علم থেকে। তালীম (تعليم) মানে : Information, Advice, Instruction, Direction, Teaching, Training, Schooling, Education, Apprenticeship.
تأديب [তাদীব] শব্দটি গঠিত হয়েছে أدب [আদব] শব্দ থেকে। আদব (أدب) মানে : Culture, Refinement, Good breeding, Good, manners, Social graces, Decorum. এ অর্থবহ أدب [আদব] শব্দটি থেকেই গঠিত হয়েছে تأديب শব্দ। তাই তাদীব শব্দের মধ্যে একদিকে যেমন এই সব অর্থও নিহিত রয়েছে, অন্যদিকে তাদীব দ্বারা Education এবং Discipline ও বুঝায়।
تدريب [তাদরীব] মানে : Habitation, Accustoming, Practice, Drill, Schooling, Training, Coaching, Tutoring
تدريس [তাদরীস] শব্দটি গঠিত হয়েছে درس [দারস্] শব্দ থেকে। তাদরীস মানে : To study, to learn, to teach, to instruct, to wipe out, to blot out, to thrash out, tution.
আভিধানিক অর্থ থেকেই পরিষ্কার হলো, এই পরিভাষাগুলো ব্যাপক অর্থবোধক। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শব্দদ্বয় অত্যন্ত প্রশস্ত ভাব বাঞ্চনাময়। তৃতীয় শব্দটি ব্যবহৃত হয় বিশেষভাবে আচরণগত সুশিক্ষাদান অর্থে। চতুর্থ শব্দটি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাংখিত অভ্যাস গড়ে তোলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। পঞ্চম শব্দটি ব্যবহৃত হয় পঠন, পাঠন, শিক্ষাদান, পাঠদান এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে অনাকাংখিত অভ্যাস ও অবস্থা দূরীকরণ অর্থে।
এছাড়া একে আরবীতে হাকিম,শারহু,ইলম,ফিকাহ বলা হয়। আর ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা শুরু হয় জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে আর তার সমাপ্তি ঘটবে আল্লাহর কাছে নিজেকে সোপার্দ করারা মধ্য দিয়ে।
এই পরিভাষাগুলো থেকে শিক্ষার সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য ও ব্যাপক পরিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এই পাঁচটি পরিভাষার মর্মার্থ সাজিয়ে লিখলে ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার তাৎপর্য পরিষ্কারভাবে বুঝা যাবে। আভিধানিক অর্থ থেকে এই পরিভাষাগুলোর মর্ম নিন্নমরূপ দাঁড়ায় :
শিক্ষার পরিধি
১. প্রবৃদ্ধি দান করা/বৃদ্ধি করা/বড় করে তোলা।
২. উন্নত করা/উঁচু করা/ অগ্রসর করানো।
৩. পূর্ণতা দান করা/মহত্তর/ মহান করা/প্রস্ফুটিত করা।
৪. জাগিয়ে তোলা/উত্থিত করা/ উজ্জীবিত করা।
৫. নির্মাণ করা/প্রতিষ্ঠিত করা/গড়ে তোলা।
৬. লালন পালন করা/ প্রতিপালন করা।
৭. শিক্ষাদান করা/শিক্ষিত করে তোলা।
৮. অভ্যাস করানো/ অনুশীলন করানো/ হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া/চর্চা করানো/নিয়মানুবর্তিতা শেখানো।
৯. পরামর্শ দেয়া/শিক্ষাপূর্ণ আদেশ দেয়া/জ্ঞাপক করা/উপদেশ দেয়।
১০. অনাকাংখিত আচরণাদি থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে শাসন করা/সুসভ্য করে গড়ে তোলার জন্যে শাসন করা।
১১. অন্তর্নিহিত শক্তি বিকশিত করা/সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করা/জন্মগত শক্তি, প্রতিভা ও যোগ্যতাকে প্রস্ফুটিত ও উদ্দীপ্ত করে দেয়া।
১২. সম্প্রসারিত করা/একটু একটু করে খোলা/বিকশিত করা।
১৩. পথ প্রদর্শন করা/পথ নির্দেশনা দান করা/সঠিক পথের সন্ধান দেয়া।
১৪. প্রেরনা দেয়া/উদ্বুদ্ধ করা/উদ্দীপ্ত করা/উৎসাহ প্রদান করা।
১৫. সন্ধান দেয়া/সংবাদ দেয়া/তথ্য প্রদান করা।
১৬. শিক্ষাদান পূর্বক নিয়মানুগ করানো।
১৭. আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান।
১৮. শিক্ষা নবিশিতে ভর্তি হওয়া।
১৯. সংস্কার করা/সংস্কৃতবান করা/সুসভ্য করা/সংশোধন করা/ঘসে মেজে পরিচ্ছন্ন করা/নির্মল করা।
২০. শালীনাতা, ভদ্রতা শোভনতা, শিষ্টাচার এবং সম্মানজনক ও মর্যাদা ব্যঞ্জক আচার ব্যবহার শেখানো।
২১. ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও অমায়িক আচরণ শেখানো।
২২. আদব কায়দা শিক্ষাদান/উন্নত জীবন প্রণালী শেখানো।
২৩. উন্নত নৈতিক আচরণ শিক্ষাদান/সচ্চরিত্র শিক্ষাদান।
২৪. প্রথা ও রীতিনীতি অভ্যস্ত করানো।
২৫. মানসিক, নৈতিক ও শারীরিক ধাত পরিগঠন করা।
২৬. কর্মদক্ষ করানো/কর্মে অভ্যস্ত/ কৌশল শেখানো/ নিপুণতা অর্জন করা।
২৭. অধ্যায়ন করা/দক্ষতা অর্জনের জন্যে মনোনিবেশের সাথে পাঠ করা/স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে অধ্যয়ন করা।
২৮. বিচার বিবেচনা করা/চিন্তাভাবনা করা/গবেষণা করা/পুংখানুপুংখ পরিক্ষা করা/অনুসন্ধান করা।
২৯. উদ্ভাবন করা।
৩০. বিদ্যার্জন করা/পাণ্ডিত্য অর্জন করা/শেখা/জানা/দক্ষতা অর্জন করা।
শিক্ষার উদ্দেশ্য :
প্রথমেই দেখা যাক, শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষীরা কে কি বলেছেন :
জন ডিউই বলেছেন, ‌শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলদ্ধি।
প্লেটোর মত হলো : শরীর আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তর্ভূক্ত।
প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিসের মতে : শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।
এরিস্টোটল বলেছেন : শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যে হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।
শিক্ষাবিদ জন লকের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ।
বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন : শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভবনা অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।
কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেল এর মতে : শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য পবিত্র জীবনের উপলব্ধি।
কমেনিয়াসের মতে : শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা।
পার্কার বলেছেন : পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্যে যেসব গুনাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুনাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন।
জীন জ্যাক রুশোর মতে : সুঅভ্যাসে গড়ে তোলাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
Bartrand Russell এর মন্তব্য হলো :
.......The education system we must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists.
স্যার পার্সীনান বলেছেন : শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো : চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুতি এবং ভালো দেহ ভালো মন গড়ে তোলা।
ডা: হাসান জামান বলেছেন :প্রত্যয় দীপ্ত মহত জীবন সাধনায় সঞ্জিবনী শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
ড: খুরশীদ আহমেদের মতে : স্বকীয় সংস্কৃতি আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি করা.........এবং জাতির ধর্ম সংস্কৃতিক সংরক্ষণ উন্নয়ন হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আল্লামা ইকবালের মতে : পূর্ণাংগ মুসলিম তৈরি করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য।
বিখ্যাত দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়েদ মওদূদী (রা) বলেন :
মানুষ কেবল চোখ দিয়েই দেখেনা, এর পেছনে রয়েছে তার সক্রিয় মন মগজ। রয়েছে তার একটা দৃষ্টিভংগি মতামত। জীবনের একটা উদ্দেশ্য লক্ষ্য আছে তার। সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রক্রিয়া তার আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে এবং জানে, সেটাকে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মৌলিক চিন্তা ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে নেয়। অতপর সেই চিন্তা ধ্যান ধারণার ভিত্তিতেই তার জীবন পদ্ধতি গড়ে উঠে। এই জীবন পদ্ধতিই হলো সংস্কৃতি। যে জাতি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস উদ্দেশ্য লক্ষ্যর অধিকারী এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনাদর্শ, তাদেরকে অব্যশ্যি তাদের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য জীবনাদর্শের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। আর সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আমাদের সমাজে অপরিসীম। তাই আমারা সকলে এই শিক্ষাকে যথাযথভাবে অর্জন করে সমগ্র সমাজে আলো ছড়ানোর জন্য ব্রতী হব

No comments:

Post a Comment

৩৮ তম বিসিএস এর রেজাল্ট

৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে পিএসসি। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক এ কথা নিশ্চিত করেন। ...