ভূমিকাঃ
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ
করেছে। সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করলেও জনগণের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত
সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে নি। বরং উল্টো বিদ্যুতের সমস্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এমনকি
এই সরকারের আমলে নতুন ৫১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেও বিদ্যুত ঘাটতির কোন দফারফা
করা যায়নি। যদিও প্রতিবছর এই বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি গুণতে হচ্ছে। আর এই
পয়সাগুলো যাচ্ছে জনগণের পকেট থেকে। ইনশাল্লাহ আমি এই আর্টিকেলে বর্তমান বিদ্যুৎ সমস্যার
ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো এবং সেই সাথে বিদ্যুৎ সমস্যার ইসলাম ভিত্তিক সমাধানও
উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।
বিদ্যুৎ সমস্যার বর্তমান বাস্তবতা
বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৯
সালের জানুয়ারি মাসে। সেসময়ে পিডিপির জেনারেশন রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে তখন পিক আওারে
বিদ্যুতের উদপাদন হচ্ছিল ৩৬০০ থেকে ৩৮০০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৪৫০০
মেগাওয়াট। আবার ২০০৯ সালের জুন মাসে পিডিপির রিপোর্ট থেকে জানা যে তখন বিদ্যুতের উদপাদন
ছিল ৩৮০১ মেগাওয়াট আর এর বিপরীতে চাহিদা ছিল ৪৫০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, সরকারী হিসেবে
ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ৭০০ মেগাওয়াটের মত। যদিও ঘাটতি প্রকৃতপক্ষে সরকারী হিসেবের চাইতে
আরো অনেক বেশী। এই একই রিপোর্ট বলছে যে গ্যাস সংকটের কারণে ৩৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম
উৎপাদিত হয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর কারিগরি ত্রুটির কারণে আরও ৭০৭ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ কম উৎপন্ন হয়েছে। তখন আওয়ামীলীগ সরকার বললো যে তাদের পক্ষে বিদ্যুৎ সমস্যার
দ্রুত সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ গ্যাস নেই। আর ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও সারিয়ে
তোলার কোন বেবস্থাও তারা নিলো না। বরং সরকার সেসময় বললো বিদ্যুৎ সমস্যার কুইক সমাধান
করার জন্য এখন নাকি ৩-৬ মাসের মধ্যে স্থাপনযোগ্য তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন
করতে হবে। তাও আবার ভাড়ায়। এতে নাকি বিদ্যুৎ সমস্যার কুইক সমাধান হবে। তাই এর নাম দিয়েছে
ওরা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু লক্কর ঝক্কর মার্কা পুরনো যন্ত্রপাতি নিয়ে
শুরু হওয়া সেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো এখনো দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার কোন সমাধান
করতে পারে নাই। বরং এই সমস্যাটিকে আরো বেশী জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে।
বর্তমানে দেশে এরকম ২৪টি রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক) , ১৮টি কুইক রেন্টাল (দ্রুতভাড়া) বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। অথচ এই ভাড়াটে কোম্পানিগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী
কখনোই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে নাই। অথচ এদেরকে ঠিকই ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে
এবং এদের পেছনে এখনো কোটি কোটি টাকা ঢালা হচ্ছে। একটি উধাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার
হবে। যেমন গত বছরের এক হিসেব থেকে দেখা যায় যে গত বছরের ২১শে এপ্রিল এই কোম্পানিগুলো
তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৩০০০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। যার মধ্যে
গ্যাস সংকটের জন্য ৩২৩ মেগাওয়াট, ফার্নেস তেলের অভাবে ১৪২৪ মেগাওয়াট এবং পানির অভাবে
৭১ মেগাওয়াট এবং যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটির কারণে ১১৭৬ মেগাওয়াট। এছাড়া পিডিপির ওয়েবসাইট
থেকে দেখা যায় যে গড়ে প্রতিদিন ১৩০০-১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের কমতি থেকেই যাচ্ছে কারণ
এই সব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে তেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অথচ এদেরকে বসিয়ে
বসিয়ে ঠিকই টাঁকা দিতে হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এইসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরও
বিদ্যুতের সমস্যা থেকেই গেলো।
এখন আসি আমাদের আর্থিক ক্ষতি প্রসঙ্গে। কুইক রেন্টাল চুক্তিতে
বলাই আছে যে এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দু ধরণের মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
একটি হচ্ছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যেটাকে বলা হয় এনার্জি প্রাইস। আরেকটি
হচ্ছে একটি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সে অনুযায়ী প্রতি
মাসে তাকে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। একে বলা হচ্ছে "ক্যাপাসিটি চার্জ "
। অর্থাৎ একটি কোম্পানি যত ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে সে অনুযায়ী সে এর মূল্য
পাবে। কিন্তু এছাড়াও তাকে "ক্যাপাসিটি চার্জ
" পে করতে হবে তার উৎপাদন ক্ষমতা
অনুযায়ী। এবং এর হিসেবের সাথে উৎপন্ন বিদ্যুতের কোন সম্পর্ক নেই। এখন যদি কোন কোম্পানি
তেল, গ্যাস বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে নাও পারে তবু সে এনার্জি
প্রাইস না পেলেও "ক্যাপাসিটি চার্জ
" পাবে। ধরুন কোন একটি কুইক রেন্টাল
কোম্পানির উতপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। এখন প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের জন্য এখানে ১৫.৯
ডলার করে ভাড়া অর্থাৎ "ক্যাপাসিটি চার্জ "
দিতে হয়। এখন যদি কোন কারণে এই কেন্দ্রটি প্রডাকশনে না যেতে পারে তারপরও প্রতি
ইউনিট হিসেবে ৫০ মেগাওয়াটের জন্য প্রায় ৬ কোটি টাকা ভাড়া অর্থাৎ লোকসান গুনতে হবে।
কারণ চুক্তিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে:
"কোন কারণে বিপিসি যদি ভাড়া বিদ্যুৎ কোম্পানিকে জ্বালানি
তেল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কোম্পানি বিদ্যুতের দামের রেন্টাল বা ভাড়ার অংশটুকু
পাবে। "(আর্টিক্যাল ২৬, তরল জ্বালানি সরবরাহ) “Any failure of BPC to supply
and deliver liquid fuel to the Rental Power Company shall entitle the Company
to receive the Rent part of the tariff…” (Article 26 Delivery and Supply of
Liquid Fuel)
অর্থাৎ, জনগণ বিদ্যুৎ পাবে না কিন্তু তাদের পকেটের পয়সা ঠিকই
কুইক রেন্টাল কোম্পানির মালিকের পকেটে গিয়ে ঢুকবে। এবং এটাই হচ্ছে, চিন্তা করুন কি
ধরণের নগ্ন দুর্নীতি। এমনিতেই গত তিন বছরে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী খাতে সরকার ভর্তুকি
দিয়েছে ৩৩ হাজার ৭৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম মোট ৬ বার বাড়ানো হলেও বিদ্যুৎ সমস্যা কমার বদলে
আরও বেড়েছে।
কিন্তু এই সরকারের কাণ্ড দেখুন কুইক রেন্টাল দুর্নীতির মাধ্যমে
দেশের বিদ্যুৎ এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার পর তারা এখন দেশের ১৫টি পুরানো বিদ্যুৎ
কেন্দ্রের ২৬টি ইউনিট সংস্কারের কথা বলেছে যা থেকে ১৬০৯ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়া
যাবে। এবং এটা কুইক রেন্টাল থেকে পাওয়া ১৩৩৫ মেগাওয়াটের চেয়ে ২৭৪ মেগাওয়াট বেশি। অথচ
এই কাজটি আগেই করা যেতো। কিন্তু সরকার এটি করেনি। কারণ তাহলে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ মিলতো না। তাছাড়া গ্যাস সংকটের কথা এই সরকার
বারবার বলেছে। কিন্তু এই সংকট সমাধান করার জন্য কোনধরণের বাস্তব পদক্ষেপ নেয়নি। এরা
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে বসিয়ে রেখেছে টাকার অভাবের কথা বলে। যার কারণে বাপেক্স
নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কার করা বা পুরানোগুলো সংস্কার করে সেগুলোকে প্রোডাকশনে পাঠাতে
পারেনি। অথচ ঠিকই কিন্তু সরকার জ্বালানী খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।
জনগণের ওপর এর বোঝা চাপিয়েছে। কুইক রেন্টালের মালিকদের টাকা দেয়া সময় সরকারের কাছে
টাকা ঠিকই থাকে কিন্তু বাপেক্সকে দেয়ার জন্য কোন টাকা ছিল না। বাপেক্সকে যদি একেবারে
শুরু থেকেই কাজে লাগানো হত তাহলে আমরা ৩০০ মিলিওন ঘনফুট গ্যাস পেতাম নতুন এবং অর্ধপরিতেক্ত
গ্যাসকূপগুলো থেকে। কিন্তু সরকার এটা না করে বরং এর উল্টোটা করলো। দেশীয় কোম্পানিকে
বসিয়ে রেখে কথিত ‘ফার্স্ট ট্র্যাক’ প্রোগ্রামের আওতায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী
কোম্পানিগুলোর কাছে টেন্ডার আহ্বান করলো। তারপর আরেক নাটক। নির্বাচিত কোম্পানির মামলা
মকাদ্দমা সংক্রান্ত ঝামেলা বা কখনো নির্বাচিত কোম্পানির কাজ করতে অনীহা প্রকাশ সব মিলিয়ে
প্রায় তিন বছর সময় নষ্টের পর কোনরকমের টেন্ডার ছাড়াই রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের
সাথে ২০ মাসের মধ্যে ১০তি কূপ খননের চুক্তি করে ফেললো। তাও আবার বাপেক্সের থেকে ৩ গুণ
বেশী মূল্যে। অথচ বাপেক্সকে আজ থেকে তিন বছর আগেই যদি এই দায়িত্ব দেয়া হত তাহলে এতদিনে
৩০০ মিলিওন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে যেতো যা দিয়ে ১৫০০ মেগাওয়াটের নতুন
গ্যাস ভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যেত। কিন্তু যেখানে প্রাইভেটাইজেশনের
নাম করে দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট চালানো আর দেশের সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে তুলে দেয়াটাই এই গণতান্ত্রিক
কুফর সরকারগুলোর কাজ সেখানে তা কিভাবে সম্ভব। দুর্ভাগ্যের বিষয় হোল কুইক রেন্টাল দুর্নীতি
শেষ হতে না হতেই সরকার সুন্দরবনে ভারতীয় কোম্পানি ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনকে
(এনটিপিসি) কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে বিপর্যয়ের আরেকটি ফ্রন্ট
খুলতে যাচ্ছে।
এখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যাকে আরো গভীরভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশের
জ্বালানী নীতির বিশ্লেষণ করাটাও প্রয়োজন।
বাংলাদেশের জ্বালানী নীতির বিশ্লেষণঃ
১-আদর্শিক ভিতিঃ
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ হয় পুঁজিবাদী জীবনাদর্শের
ভিত্তিতে। এখানে মনে করা হয় সরকার প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের বেবস্থাপনায় অক্ষম না
হলেও অন্তত পক্ষে অদক্ষ। তাই এগুলোকে প্রাইভেট সেক্টরের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। আর এজন্যই
বাংলাদেশ সরকার বারবার সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ডেকে আনছে আর নাহয় দেশীয়
বেনিয়াদের কাছে জনগণের সম্পদ লুটপাটের জন্য তুলে দিচ্ছে।
২-বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে অসম চুক্তিঃ
এপর্যন্ত বাংলাদেশের সবকটি সরকার জ্বালানী সম্পদের ক্ষেত্রে
বিদেশীদের সাথে যৌথ পার্টনারশিপে গিয়েছে। যেটাকে উৎপাদন এবং বণ্টন চুক্তি বলা হয়। এটা
স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে এদেশের রাজনীতিবিদদের মাঝে জ্বালানী নিরাপত্তাকে ঘিরে সত্যিকারের
কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং ভিশন নেই। তাই তারা বারবার এই সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানিগুলোকে
আহ্বান করে। অথচ এই কোম্পানিগুলো আমাদের গ্যাস আমাদের কাছে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে
এবং আমাদেরকে তা ডলারে কিনতে হয় আন্তর্জাতিক রেট অনুযায়ী। কারণ ওই কোম্পানিগুলো শুধু
মুনাফা বোঝে এবং তা দ্রুততম কম সময়ের মধ্যেই তারা তুলে নিতে চায়।
৩-দুর্নীতিঃ
বাংলাদেশের সব সরকারই দুর্নীতিগ্রস্থ বিধায় এরা খুব সহজেই জনগণের
স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে দেশের জ্বালানী খাতকে তুলে দিচ্ছে।
এরা জ্বালানী সংক্রান্ত স্ট্রেটিজিক বিষয়গুলো বুঝে না বা বুঝতে চায়ও না। তাই সামান্য
উৎকোচের বিনিময়ে জনগণের হককে এরা কাফেরদের কাছে বিক্রি করে দেয়। কারণ এদের রাজনীতির
ভিত্তি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহিতা ধারণা এখানে অনুপস্থিত।
৪-উচ্চাকাংখার অনুপস্থিতিঃ
আমরা পূর্বেই বলেছি যে বাংলাদেশ যেহেতু বর্তমান বিশ্ব বেবস্থায়
পুঁজিবাদী ব্লকে অবস্থান করছে তাই এদেশের পাচাটা রাজনীতিবিদরা আমাদের উচ্ছিষ্টভোগী
একটি জাতীতে পরিণত করেছে। এমন একটা জাতী যার নিজের কোন উচ্চাবিলাস নেই। তাই সবক্ষেত্রেই
আমরা পরনির্ভরশীল হয়ে আছি। জ্বালানী এবং বিদ্যুৎ খাতও এর বেতিক্রম নয়। একারণেই এখনো
পর্যন্ত আমাদের স্বাধীন এবং নিজস্ব জ্বালানী নীতি গড়ে ওঠেনি।
এধরণের নতজানু নীতি এবং পশ্চিমাদের পাচাটা মেরুদণ্ডহীন রাজনৈতিক
গোষ্ঠীগুলোর(আওয়ামী মহাজোট-বিএনপি জোট)কারণেই আজ আমাদের জ্বালানী এবং বিদ্যুৎ খাতে
ধুকছে।
বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী সমস্যার সমাধানে ইসলামের নির্দেশনাঃ
ইসলাম আল্লাহ(সূওতা)প্রদত্ত এক পুরনাঙ্গ জীবন বেবস্থা। জীবনের
এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই যে ব্যাপারে ইসলাম নিশ্চুপ থেকেছে। বেক্তি এবং সমষ্টির জন্য
এখানে রয়েছে সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা। তাই বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী সম্পদের ব্যাপারেও ইসলামের
বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহ(সূওতা) পবিত্র কোরানে
বলছেন, ''আমি আপনার প্রতি এমন কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা''।
[সূরা নাহলঃ৮৯]
আমরা এখানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
১- আদর্শিক অবস্থানঃ
যেহেতু আল্লাহ্ হচ্ছেন মানুষ, জীবন এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা
তাই একমাত্র তিনিই তার সৃষ্টির প্রকৃতি এবং চাহিদা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত। তাই ইসলাম
মানুষের বেস্টিক এবং সামস্টিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখেই জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্তুসমূহের
মালিকানার ধরণ এবং প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয় বণ্টনের পদ্ধতি এবং ভোগের
নীতিমালাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সম্পদের ভোগ দখলের নিয়ম কানুন নির্ধারণের
মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনভাবেই মানুষের হাতে ছেড়ে দেবেন না। কেনোনা মানুষ সুযোগ
পেলেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। অন্যকে বঞ্চিত করে পুরোটাই নিজে ভোগ করতে চায়। তাই এব্যাপারে
মানুষকে আইন প্রণয়নের কোন ক্ষমতা আল্লাহ্ দেননি। বিদ্যুতের মালিকানা, ব্যাবহার এবং
বণ্টনের পুরো প্রক্রিয়াটিই ইসলাম এই নীতির আলোকেই সঙ্ঘটিত করেছে।
২-জ্বালানী সম্পদের মালিকানাঃ
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের মালিকানা তিন ধরণের। বেক্তিগত সম্পদ,
গণমালিকানাধীন সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। বিদ্যুৎ এবং সেই সাথে যাবতীয় জ্বালানী উপকরণসমূহ
যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল, কয়লাসহ যাবতীয় জ্বালানী হচ্ছে গণমালিকানাধীন সম্পদের
আওতাধীন। গণমালিকানাধীন সম্পদ হচ্ছে সেই সম্পদ যা বেক্তিরও নয় আবার রাষ্ট্রেরও নয়।
বরং এ সম্পদ জনগণের যা ইসলামী জনগণের পক্ষ থেকে খলিফাহ দেখা শোনা করেন এবং জনকল্যাণের
জন্য একে কাজে লাগান। এবং এর মূল্য গ্রহণও নিষিদ্ধ।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেন,
“তিন জিনিষের মধ্যে সকল মানুষ শরীক। এগুলো হচ্ছে পানি, ঘাস (চারণ ভূমি) এবং আগুন।
[সুনানে আবু দাউদ]
উপরোক্ত হাদিসে ‘আগুন’ শব্দটি এসেছে যার মাফহুম(সম্প্রসারিত
অর্থ) হচ্ছে জ্বালানী। আর বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস, কয়লা এসবই জ্বালানীর এক একটি উৎস। তাই
এসবই গণমালিকানাধীন সম্পদ। এসব সম্পদ কখনোই বেক্তি মালিকানায় দেয়া যাবে না। কেননা এর
সাথে গোঁটা সমাজের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। আবার এই ধরণের সম্পদকে কোন প্রাইভেট কোম্পানির
কাছেও দেয়া যাবে না। খলিফাহ বিদ্যুৎ খাতকে কোন বিদেশী কোম্পানির হাওয়ালা করে দিতেও
পারবেন না। বরং ইসলামী রাষ্ট্র নিজ তত্বাবধানে এগুলোর উৎপাদন এবং বিতরণের বেবস্থা করবে
এবং জনগণের কাছে থেকে এর কোন মূল্য নেবে না। যদি নেও তা হবে নামেমাত্র সার্ভিস চার্জ
যা পুনরায় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী খাতেই বিনিয়োগ করা হবে যাতে করে জনগণকে সহজে সেবা দেয়া
যায়।
৩-ইসলামী রাষ্ট্রের উচ্চাকাংখাই তাকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী
খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবেঃ
ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে একটি পরাশক্তি। তার থাকবে
সুদূরপ্রসারী ভিশন এবং লক্ষ্য। আর সেটি প্রণীত হবে ইসলামের আহ্বান সমগ্র বিশ্বের কাছে
দাওয়াত এবং জিহাদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়ার চাহিদা মোতাবেক।
কারণ আল্লাহ্(সূওতা)বলেছেন,
“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন (জীবনব্যবস্থা)
সহকারে, যেন এই দ্বীন অন্যান্য দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন...।” [সুরা আত্ -তাওবাহ্
- ৩৩]
যার কারণে খিলাফত তার প্রথম দিন থেকেই এই আদর্শিক উচ্চাকাঙ্খা
নিয়েই কাজ করবে। আর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক শিল্পোন্নয়ন। যার মূলে থাকবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র
তৈরির কারখানা। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রকে আদর্শিক লড়াইয়ের পাশাপাশি কুফর শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে
সশস্ত্র লড়াইয়েও অবতীর্ণ হতে হবে। আর এটি জানা কথা যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের
সংযোগ ছাড়া কোন জাতীর পক্ষেই শিল্পে উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং ইসলামী খিলাফত
রাষ্ট্র তার আদর্শিক প্রয়োজন থেকেই বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের
সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
৪-স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার নিশ্চিতকরণঃ
ইসলামী খিলাফত বেবস্থায় খলিফাহ কোন আইন প্রণয়ন করতে পারেন না।
বরং তিনি নিজেই আল্লাহ্র(সূওতা)আইনের দাস। তাই তিনি তা মেনে চলতে বাধ্য। তিনি জানেন
যে কোরান এবং সুনাহ’র আলোকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানী সম্পদ কিভাবে আরোহণ, বণ্টন এবং এর
সুবিধা তাকে জনগণের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে জনগণও জানবে এই সম্পদগুলো ব্যাবহারের
ইসলামী নীতিমালা কি। তাই তারা খুব সহজেই নিজেদেরন অধিকার বুঝে নিতে পারবে। এবং খলিফাহকে
এব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতেও সক্ষম হবে। তাই স্বেচ্ছাচারিতার
দরজা বন্ধ হয়ে সর্বক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে ইনশাল্লাহ।
শেষকথাঃ
ইসলামের জ্বালানী নীতি এবং এর অ্যাপ্লাইড বিষয় আশয় নিয়ে বিস্তারিত
লিখতে গেলে একখানা সতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই সুযোগ এখানে
নেই। তাই ইসলাম কিভাবে বিদ্যুৎসহ পুরো এনার্জি সেক্টরের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে
সে সম্পর্কে সবাইকে একটা খসড়া ধারণা দেয়াই ছিল এই আর্টিকেলর উদ্দেশ্য। আশা করি বিস্তারিতভাবে
না হলেও জ্বালানী সম্পরকিত ইসলামের নীতিমালাগুলোর সারটা অন্তত সবাই পেয়ে গেছেন। বর্তমানে
আমাদের ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র নেই তাই ইসলামের দিকনির্দেশনাগুলো কার্যকর করা যাচ্ছে
না। সুতরাং আমাদের উচিত সমাজের সমস্যারগুলোর ইসলামী সমাধানগুলো সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে
দেয়া যাতে করে উম্মাহর মাঝে ইসলামী চিন্তার ওপর আবারো কনফিডেন্স ফিরে আসে এবং ইসলাম
এবং ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে একটি জনমত (Popular Base) তৈরি হয়। এই উম্মাহ যখন তার দৈনন্দিন
জীবন সমস্যার সমাধান ইসলামের মাঝে খুঁজে পাবে তখনই সে তার জীবনের যাবতীয় বিষয়েগুলোর
সাথে ইসলামী আক্কিদার একটা গভীর সম্পর্ক অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। যেটা তাকে ইসলাম বাস্তবায়নের
জন্য তাড়িত করবে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার একটি সত্যিকার গণআন্দোলন উম্মাহর মাঝে তৈরি
হবে। আল্লাহ্(সূওতা) আমাদের সকলকে সমাজের কাছে ইসলামী জীবন বেবস্থার দাওয়াত পৌঁছে
দেয়ার তৌফিক দিন।